দেবীপক্ষের এই আবহে কাশবন আর দূর গাঁয়ের ঢাকের বাদ্যি মিলেমিশে যে মায়াবী কুয়াশা তৈরি হয়, তার সঙ্গে উৎসবের বিশেষ ফারাক করে না বাঙালি। অথচ উমার এই মর্ত্য সফরে তাঁর রূপের বিভিন্নতা শুনলে আশ্চর্য হতে হয়। মা দুর্গা বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নরূপে অবতীর্ণ হন। কখনো তিনি বাসন্তী, কখনও ছিন্নমস্তা, কখনো কমলা আবার কখনো বা বগলা-রূপিনী। আর ঠিক তেমনি করেই মা 'বড়দেবী' নাম ধারণ করে অবতীর্ণ হন কোচবিহারে।
কোচবিহার রাজবংশের মা দুর্গা 'বড়দেবী' নামেই পরিচিতা। প্রায় ৫০০ বছর ধরে চলে আসা এই পুজোর কিছু ইতিহাস কোচবিহার এবং তার আশপাশের অঞ্চলগুলিতে বেশ প্রচলিত। আনুমানিক ১৫১০ সালে তৎকালীন কোচবিহারের রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজা বিশ্বসংহের সুযোগ্য পুত্র মহারাজা নরনারায়ণ এই পুজোর প্রচলন করেন। জনশ্রুতি অনুযায়ী, মা দুর্গা 'বড়দেবী' রূপে অবতীর্ণ হয়ে মহারাজাকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে তাঁর পুজো প্রচলন করতে বলেন। কথিত আছে, প্রাচীন গুঞ্জবাড়ির ডাঙুরাই মন্দিরে শ্রাবণমাসের শুক্লা অষ্টমী তিথিতে ময়না গাছের ডাল দিয়ে এই মূর্তি তৈরির কাজ শুরু হয়। পশ্চিমবঙ্গে বা পশ্চিমবঙ্গের বাইরে অনুষ্ঠিত দুর্গা মায়ের রূপ এবং দুর্গা পুজোর রীতি পদ্ধতির থেকে বড়দেবীর পুজো অনেকটাই আলাদা, যা এখনো কোচবিহার রাজপরিবারের নিজস্ব পুজো বলে মানা হয়।
আরও পড়ুন
নাম 'পটেশ্বরী', মূর্তির বদলে ছবিতেই দূর্গাপূজা বর্ধমান রাজবাড়িতে
বড়দেবীর চেহারার সঙ্গে 'কোচ' জাতির মানুষের চেহারার বেশ কিছু মিল লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া বর্তমানে রাজবংশী গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত মানুষের দৈহিক গঠনের সাথেও যথেষ্ট সাযুজ্য লক্ষ্যণীয়। প্রাচীন এই পুজোয় বড়দেবীর গাত্রবর্ণ লাল, আকর্ণনয়ন, খর্ব নাশা এবং মুখের আকৃতি খানিক চ্যাপ্টা প্রকৃতির। মায়ের মূর্তি ১১ ফুট লম্বা হয়। অসুরের গাত্রবর্ণ এখানে সবুজ। মায়ের সাথে বাহন হিসেবে দেখতে পাওয়া যায় সিংহ, বাঘকে। এখানে 'বড়দেবী' রূপী মা সপরিবারে অবতীর্ণ হন না, তিনি তাঁর দুই সখী জয়া এবং বিজয়াকে সঙ্গে করে মর্ত্যে অবতীর্ণ হন।
দেবী এক এক দিন এক এক রূপে পূজিত হন এখানে। আগে পুজো চলাকালীন নরবলির প্রচলন ছিল। আড়াইশো বছর আগে এই প্রথা বন্ধ করেন ১৯তম কোচ মহারাজা নরেন্দ্র নারায়ণ ভূপ, চালু হয় মোষবলি। বড়দেবীর পুজো চলাকালীন সন্ধিপুজোতে মন্দির প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় গুপ্তপূজা। এই সময় মন্দিরে দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। শুধুমাত্র পুরোহিতপ্রধান এবং রাজপরিবারের সদস্যরাই তাতে উপস্থিত থাকতে পারেন। এই গুপ্তপূজা নরবলিকেন্দ্রিক একটি পদ্ধতি। কামসানাইট উপাধি পাওয়া কোনো প্রতিনিধি তাঁর আঙুল কেটে কয়েক ফোঁটা রক্ত দেন দেবীর চরণে। বিশ্বাস যে, সামান্য হলেও নররক্তেই তুষ্ট হন দেবী। একটি নির্দিষ্ট বংশের পুরুষই এই রক্ত দিয়ে থাকেন, তাই প্রচলিত। চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি নরমূর্তির বলিও এখানে প্রচলিত।
ষষ্ঠী থেকে সাড়ম্বরে পুজো হলেও মায়ের ভোগে থাকে শুধুই পায়েস। সেদিন প্রথা অনুযায়ী ৫টি পাঠা বলি হয়। ওইদিন চাল, ডাল, সবজি ও বলির মাংস একত্র করে অভিনব ও এক বিশেষ আমিষ খিচুড়ি মায়ের প্রসাদে দেওয়া হয়। অঞ্জলি হওয়ার পর সবাই সেই ভোগ গ্রহণ করে। প্রথমে জেলা শাসক, জেলার সরকারি কর্মচারী ও রাজবাড়ির লোকেরা অঞ্জলি প্রদান করেন এবং পরে বাকিরা। এটাই রাজবাড়ীর দীর্ঘদিনের প্রথা।
কালের নিয়মে রাজতন্ত্র থেকে বহুদূরে সরে এসেছে কোচবিহারের রাজপরিবার। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী, প্রথা অনুযায়ী দেবী পুজো চলছে। কোচবিহারের প্রচলন অনুযায়ী বড় দেবীর মূর্তির বিসর্জনের পরই বাকি সব প্রতিমা নিরঞ্জন হয়। দেবী প্রতিমা বিসর্জন হয় রাজপরিবারের নিজস্ব যমুনা দীঘিতে।
ইতিহাসের চাদরে কত কিছুই ঢাকা পড়ে যায়, ধুলো পড়ে যায় ঐতিহ্যের গায়ে। এমনও কথিত আছে পুজোর আগে রাজবাড়ি সংলগ্ন মাঠ থেকে স্বয়ং রাজা হাতির পিঠে চেপে খঞ্জনা পাখি ছাড়তেন। সেই পাখি যেদিকে যেত রাজার ভাগ্য নির্ধারণ হত সেই দিক বুঝে। শেষ স্বাধীন রাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ভূপের মৃত্যুর পর এই পাখি ওড়ানোর অনুষ্ঠানও বন্ধ হয়ে যায়।
সমস্ত প্রাচীন ইতিহাসের বাইরে গিয়েও এই পুজোর মহিমা একফোঁটাও কমেনি। লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয় পুজোর কদিন। মা দুর্গার রূপ স্নেহের এবং সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি হলেও এখানকার বড়দেবীর রূপ মনে খানিক ভীতির সঞ্চার করে। তবু দুর্গার এই রূপের কাছে ৫০০ বছরের ইতিহাস চাপা পড়ে আছে, বাঁধা পড়ে আছে আঞ্চলিক সমাজ জীবন, বয়ে চলেছে আবহমান কাল।