কয়েকদিন আগেই উত্তরপ্রদেশের ধর্ষণের ঘটনার প্রেক্ষিতে বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি মার্কণ্ডেয় কাটজু। ধর্ষণের ঘটনায় জন্য তিনি দায়ী করেছিলেন বেকারত্বকে। মন্তব্য করেছিলেন, যৌনতা পুরুষের স্বাভাবিক তাগিদ। প্রাক্তন বিচারপতির এই বেফাঁস মন্তব্যকে ঘিরে বিতর্কের ঝড় বয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কাটজু আছেন নিজের মধ্যেই। এবার তাঁর বিরুদ্ধে বাঙালিদের বিরুদ্ধে কুমন্তব্য করার অভিযোগে সরগরম সোশ্যাল মিডিয়া।
আচমকাই সোশ্যাল মিডিয়ায় বাঙালি এবং বাংলাকে উল্লেখ করে একাধিক পোস্ট করেন মার্কণ্ডেয় কাটজু। নিতান্ত মজার ছলে করা হলেও তার মধ্যে যে ব্যাঙ্গাত্মক মনোভাব লুকিয়েছিল, সেটা নজরে আসতে দেরি হয়নি। ফলে শুরু হয় বিতর্ক, এবং, একনাগাড়ে বেশ কয়েকটি পোস্ট করার পর সম্ভবত বিতর্কের মুখে পড়েই সেগুলিকে মুছে ফেলতে দেখা যায় প্রাক্তন বিচারপতিকে।
এক ঝলকে মার্কণ্ডেয় কাটজুর পোস্টগুলো দেখলে মনে হবে সেগুলি নিতান্তই মজার ছলে বলা। কিন্তু একনাগাড়ে একের পর এক পোস্ট যখন একই ভঙ্গিতে আসতে থাকে, তখনই খটকা লাগতে শুরু করে একটু। তাহলে কি সমগ্র হিন্দি বলয় এখন যে ‘বাঙালি বিদ্বেষ’ রোগে আক্রান্ত, প্রাক্তন বিচারপতিও তাতে সামিল হয়ে পড়লেন? মজার ব্যাপার হল, কাটজুর একটি পোস্টে রীতিমতো তাঁর জাতিবিদ্বেষ সামনে এনে দিয়েছেন মুহাম্মদ আলি বলে একজন ব্যক্তি। সেই পোস্টে কাটজু লিখেছিলেন, বাঙালিদের চিরাচরিত জল ‘পান’ করার বদলে জল ‘খাওয়া’র প্রসঙ্গ উল্লেখ করে। তার উত্তরে মুহাম্মদ আলি লিখেছেন, শুধু বাংলা বলে নয়, যে কোনো ভাষার ক্ষেত্রেই এ ধরনের ঘটনা ঘটেই থাকে। উদাহরণ দিয়ে ইংরাজি বা হিন্দির উদাহরণ দিয়েও তিনি দেখিয়েছেন যে, তুল্যমূল্য বিচার করলে এমন হাস্যকর ঘটনা দেখতে পাওয়া যাবে সেখানেও। এবং তার পরেই তিনি উল্লেখ করেছেন, বাংলা ভাষার ঐতিহ্যের কাছাকাছি হিন্দি ভাষাকে পৌঁছতে এখনও অপেক্ষা করতে হবে কম করে আরো ১০০ বছর। তার থেকেও বড়ো চমক হল, এই মন্তব্যের নিচে তিনি নিজের পরিচয় দিয়েছেন একজন মালয়ালি মানুষ হিসেবে।
প্রশ্ন হল, এইভাবে একটি নির্দিষ্ট ভাষাকে নিয়ে এমন নিম্নস্তরের ঠাট্টা-ইয়ার্কি করা কি নিতান্তই শোভনীয়? সুপ্রিম কোর্টের যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিচারপতি ছিলেন মার্কণ্ডেয় কাটজু। কিন্তু এমন একটি মানুষের এই ব্যবহারকে নিতান্তই অধঃপতন বলে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। যে ভাষাকে উল্লেখ করে এই মন্তব্যগুলি কাটজু করেছেন, সেগুলি বি-গ্রেড বা সি-গ্রেডের জোকসের বইতে পাওয়া যায়। তার থেকেও বড় কথা হল, একটি ভাষা নানা রকম ভাঙচুরের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যায়। কারণ, ভাষার মূল বক্তব্যই হল সহজে ভাব প্রকাশ করা। তাই সে ক্ষেত্রে কিছু খুঁটিনাটি ব্যাপার ঢুকেই আসে সাধারণ কিছু কথার মধ্যে। তাই বাংলায় যেমন আমরা জল ‘খাই’, তেমনই বাক্য গঠন অনুযায়ী মানে করলে বাংলার মতোই হিন্দিতেও মানুষ হাওয়া ‘খেতে যায়’ এবং ইংরেজিতে ঠান্ডা ‘লাগে না’, ঠান্ডা তাদেরকে ‘ধরে’।
আরও পড়ুন
ধর্ষণ কিংবা যৌন নির্যাতনের শিকার হন পুরুষরাও; 'কুণ্ঠা'র আড়ালেই চাপা পড়ে প্রতিবাদ?
এছাড়াও কাটজুর অপর একটি পোস্টে উঠে এসেছে বাঙালি এবং বিহারিদের নিয়ে নিন্দনীয় মন্তব্য। একজন বাঙালির বাড়ি থেকে ভজনের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার নিমন্ত্রণ পেয়ে একজন বিহারি সেখানে ভোজন হবে ভেবে পৌঁছে গেছেন। কিন্তু পৌঁছে গিয়ে খাবারদাবারের ব্যাবস্থা না দেখতে পেয়ে সেদিন থেকেই নাকি বিহারিরা বাঙালিদেরকে ‘কাঙালি’ বলে ডাকা শুরু করেছে। পোস্টের ভাষা, শব্দ চয়নই বলে দেয় কতটা নিচু মানসিকতার হতে পারে এই বক্তব্য।
এরপর বাঙালির রসগোল্লা প্রীতির বিষয়টিকেও নিয়েও মজা করা হয়েছে। এবং যতই সময় এগিয়েছে ততই কাটজুর পোস্টের মধ্যে ধরা পড়েছে রাজনৈতিক বক্তব্য। যেখানে বলা হয়েছে যে, একজন সাধারণ শিশু জন্মানোর পর সে কেঁদে ওঠে। কিন্তু, একজন বাঙালি শিশু জন্মানোর পরে তার এক হাতে থাকে লাল ঝান্ডা এবং সে চিৎকার করতে থাকে ‘চলবে না চলবে না’!
আরও পড়ুন
কৃষিক্ষেত্রেও ‘বেসরকারিকরণ’? কৃষি সংশোধনী বিল নিয়ে বিতর্ক চরমে
খুব স্বাভাবিকভাবেই এই ঘটনার পরেই অনেকেই এর প্রতিবাদ করেছেন সোশ্যাল মিডিয়াতেই। কিন্তু যে ধরনের গর্জন ওঠার কথা ছিল, তা কিন্তু দেখা যায়নি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে যে, এটাও কি সেই চিরাচরিত বাঙালি ঔদার্য? যে যাই বলুক না কেন, বাঙালিরা নিজের ওজন বোঝে বলেই সেসব কুকথাকে পাত্তা না দিয়ে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায়? নাকি অপমান গায়ে মেখে পথ চলতে শিখে গেছে বাঙালিরা? প্রশ্ন উঠছে যে, যদি এই একই ঘটনা দক্ষিণ ভারতীয় অথবা মারাঠি ভাষাকে কেন্দ্র করে ঘটত, তাহলে কি প্রতিবাদটা এতটাই ফ্যাকাশে হত?
প্রশ্নগুলো থাকছেই। তার সঙ্গেই থাকছে আরও একটা হতাশা যে, জাতি বিদ্বেষের বিষ কীভাবে দিনে দিনে ছেয়ে ফেলেছে বাতাস। তবে এই প্রেক্ষিতে এটাও মনে রাখতে হবে যে, এত দিন যে ভাবে সর্দারজি জোকস, উড়ে জোকস বা বিহারি জোকসকে হাতিয়ার করে বাংলায় যেভাবে মজার পাত্র করা হয়েছে পাঞ্জাবী, উড়িয়া কিংবা বিহারিদের, তাতেও কিন্তু লাগাম টানার সময় হয়েছে এবার। নইলে নিজেদের বিরুদ্ধে একই ঘটনা ঘটলে, পায়ের তলার মাটি নড়বড়েই থেকে যাবে।
আরও পড়ুন
ভারতীয় হাইকোর্টের প্রথম মহিলা বিচারক তিনি, লড়াই করেছেন নারীর অধিকার নিয়েও
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor