সুখে হোক, বা বিরহে— তাঁর গান সবসময় সঙ্গ দিয়েছে আমাদের। তাঁর কথাতেই আশ্রয় নিয়েছি আমরা। সেই রবীন্দ্র সঙ্গীত আর বিশ্বভারতী নিয়ে তৈরি হল বিতর্ক। বুধবার বিশ্বভারতীর সাপ্তাহিক উপাসনায় রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া হল হিন্দিতে। এমনকি, আচার্যও নিজের বক্তব্য রাখলেন হিন্দিতে। যা নিয়ে আবারও বিতর্ক শুরু হয়েছে নানা মহলে।
১৮৯২ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই উপাসনাগৃহটি নির্মাণ করেন, উদ্বোধন করেন দেবেন্দ্রনাথের বড় ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথ। রবি ঠাকুরের বিশ্বভারতী তৈরি হয় তার অনেক পরে, ১৯২১ সালে। ১৮৯২ সাল থেকেই প্রতি সপ্তাহে বুধ ও বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক উপাসনা হয়ে আসছে। পরবর্তীকালে বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষক শিক্ষিকারা এই প্রথা এগিয়ে নিয়ে গেছেন। সাপ্তাহিক উপাসনার দিন হিসাবেই এতদিন বুধ ও বৃহস্পতিবার ছুটি থাকত বিশ্ববিদ্যালয়।
শান্তিনিকেতনের সাপ্তাহিক উপাসনা একটি ঐতিহ্যের পরিচয়। আর এই ঐতিহ্যশালী অনুষ্ঠানকে ঘিরেই তৈরি হয় বিতর্ক। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক উপাসনায় রবীন্দ্রনাথের গান ও আচার্যের পাঠ বক্তৃতা হয় হিন্দিতে। আর তাতেই ক্ষুব্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী থেকে শিক্ষক শিক্ষিকাদের একাংশ। সূত্রের খবর, এইদিন উপাসনাগৃহে আচার্যের পদে আসীন ছিলেন হিন্দি ভবনের অধ্যাপিকা মঞ্জুরানি সিংহ। উপস্থিত ছিলেন উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীও। মঞ্জুরানি দেবী হিন্দিভাষী, এবং বাংলায় তেমন সড়গড় নন। তাই তিনি তাঁর বক্তৃতা পড়েন হিন্দিতেই। কিন্তু এরপরেই সঙ্গীতভবনের ছাত্রছাত্রীরা পরিবেশন করেন 'ধ্বনিল আহ্বান' এবং 'ওই আসনতলে' গানদুটি। কিন্তু মূল বাংলা কথার বদলে গানে উঠে আসে হিন্দি অনুবাদ। আর এর ফলেই বিতর্ক তৈরি হয় অন্দরমহলে।
ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক শিক্ষিকাদের একাংশ অবশ্য এতে আপত্তির কোনো কারণ দেখছেন না। তাঁদের মতে, রবীন্দ্রনাথ নিজেও চাইতেন ভাবের আদানপ্রদানের জন্য নানা ভাষাকে গুরুত্ব দিতে। সেই কারণেই তো 'গীতাঞ্জলি'র অনুবাদ করেছেন নানা ভাষায়। তাই তাঁর গান অন্য ভাষায় অনুবাদ করা হলে, না প্রথা ভেঙে উপাসনায় সেই অনুবাদ গাওয়া হলেই বা আপত্তির কী আছে?
অন্যদিকে মূলত অনুষ্ঠানের ঐতিহ্যের কথা বলেই এই ঘটনার বিরোধিতা করছেন অনেকে। ভারতের সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান এই প্রতিষ্ঠান। আর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার অন্যতম কেন্দ্রও এটি। কলাভবনের এক ছাত্রের মতে, "অন্যান্য ভাষায় অবশ্যই অনুবাদ হোক। তবে উপাসনাগৃহে বাঙলাতেই গাওয়া হোক তাঁর গান।" ১২৮ বছরের ইতিহাসে মঞ্জুরানি দেবীর আগেও অনেক হিন্দিভাষী আচার্যের পদে আসীন ছিলেন। তাঁরাও বাঙলাতেই বক্তব্য রেখেছেন। এমনকি বিশ্বের নানা দেশ থেকে আসা পড়ুয়াদেরও বাংলা ভাষা বা বাংলা গানের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠতে সমস্যা হয় না। এর জন্য কোনো বিশেষ ভাষা প্রশিক্ষণ কোর্সেরও দরকার পড়েনি কোনোদিন। ফলে বুধবারের এই ঘটনাকে বিশ্বভারতীর ঐতিহ্যের উপর বড়ো আঘাত বলেই মনে করছেন অনেকে।
এই বছরের শুরুতেই এতদিনের প্রথা ভেঙে সাপ্তাহিক ছুটির দিন বুধ ও বৃহস্পতি থেকে পরিবর্তন করে শনি ও রবিবার করা হয়। পড়ুয়া বা শিক্ষকমণ্ডলীর কোনো আপত্তির কথা শোনেননি কর্তৃপক্ষ। তারপর এই ঘটনায় সেই ক্ষোভকেই উস্কে দিয়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথ শুধু বাংলার নন। তিনি ভারতের প্রতিটি মানুষেরও। তাঁর রচনা, সেটা গানই হোক বা গল্প— তার অনুবাদ সব ভাষায় হলে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। সেই ভাব তাঁরাও বুঝতে পারবেন নিজ নিজ ভাষায়। বেশ কিছু সিনেমাতেও রবীন্দ্রসঙ্গীতের হিন্দি অনুবাদ করা হয়েছে। কিন্তু এসবের বাইরেও আরও একটা শঙ্কা কাজ করছে নানা মহলে। এইভাবে কি একটি নির্দিষ্ট ভাষার অনুপ্রবেশও হচ্ছে না? আপনার কী মনে হয়?