সময়টা ১৯২৮ সাল। মাত্র ৬ বছর হল জীবনের প্রথম চাকরিতে ঢুকেছেন জীবনানন্দ দাশ। সিটি কলেজের অস্থায়ী শিক্ষক তিনি। আগের বছরই প্রকাশ পেয়েছে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ‘ঝরা পালক’। আর এর মধ্যেই আরও এক ঘটনা ঘটে গেল কবির জীবনে। ৬ বছরের মাথায় খোয়া গেল প্রথম চাকরিটি। এই ঘটনাটি নিয়ে অবশ্য নানা ধরণের মিথ প্রচলিত আছে। ঠিক কী কারণে তাঁর চাকরি খোয়া গেল, সেটা পরিষ্কার হয়নি কোথাও। অনেকে বলেন, কবিতায় অশ্লীলতার অভিযোগেই বহিষ্কার করা হয়েছিল তাঁকে। তবে জীবনানন্দের বাবা সত্যেন্দ্র দাশকে অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্র লিখছেন, ‘আর্থিক কারণে আপাতত আপনার ছেলেকে ছাঁটাই করা হলেও আবার যখন অধ্যাপক নেওয়া হবে, তখন তাঁকে নেওয়া হবে।’ আর এই আর্থিক কারণের পিছনেই রয়েছে আরও একটি ঘটনা। নিছক একটি সরস্বতী পুজোর পরিকল্পনাকে ঘিরে সমস্যার সূত্রপাত। আর তার মধ্যেই বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্র সহ বাংলার অসংখ্য প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব।
সরস্বতী পুজো মানে বাঙালির ১৩ পার্বণের এক বড়ো পার্বণ। বিশেষ করে স্কুল-কলেজের পড়ুয়াদের কাছে দিনটা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আজকাল অবশ্য তার সবচেয়ে বড়ো পরিচয় বাঙালির ভ্যালেন্টাইনস ডে হিসাবেই। কিন্তু ১৯২৮ সালে সরস্বতী পুজো মানে একান্তভাবেই বাগদেবীর আরাধনা। বিদ্যার দেবীর পুজো। শহর কলকাতার অনেক ছাত্রাবাসেই তখন ঘটা করে পালিত হয় সরস্বতী পুজো। ঠিক এই সময় রামমোহন হোস্টেলের হিন্দু ছাত্ররাও ঠিক করলেন, তাঁরা সরস্বতী পুজো করবেন। শুরু হল প্রস্তুতি। মাঝখানে গোল বাঁধল কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে।
ব্রাহ্ম সমাজের আনন্দমোহন বসুর হাতে সিটি কলেজের প্রতিষ্ঠা। অবশ্য সব ধর্মের ছাত্রদের জন্যই পঠনপাঠন চলত একইভাবে। কিন্তু কলেজ ও ছাত্রাবাসের জীবনধারার মধ্যে একটা ব্রাহ্ম প্রভাব ছিলই। ফলে সেখানে মূর্তিপূজা নিয়ে আপত্তি জানালেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্র সরাসরি ছাত্রদের সংযত হতে বললেন। কিন্তু তাতে লাভ হল না। কারণ হিন্দু ছাত্রদের দাবির সপক্ষে এসে দাঁড়ালেন স্বয়ং সুভাষচন্দ্র বসু। চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর তিনিই বাংলার তরুণ-তুর্কী নেতা। সুভাষ জানিয়ে দিলেন, সরস্বতী পুজো হবে। আসলে সরস্বতী পুজো নিয়ে একধরণের দুর্বলতা সুভাষচন্দ্রের মধ্যে বরাবরই ছিল।
অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম পরিবারের সন্তান হলেও সরস্বতীর কথা তাঁর লেখাতেও উঠে এসেছে বারবার। ‘বাল্মিকী প্রতিভা’-র সেই শেষ দৃশ্যের কথা তো মনে পড়বেই। কিন্তু এই বিতর্কের সুয় রবীন্দ্রনাথকে দেখা গেল একেবারেই ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিনিধি হিসাবে। ‘দ্য সরস্বতী পূজা ইন দ্য সিটি কলেজ হোস্টেল’ শীর্ষক প্রতিবেদনে তিনি লিখলেন, “সিটি কলেজ ব্রাহ্মদের, এবং ব্রাহ্মরা প্রতিমাপূজক নহেন, এ-কথা প্রত্যেক ছাত্রই জানেন। কলেজ প্রতিষ্ঠার ৫০ বৎসর পরে হঠাৎ সেখানে প্রতিমা পূজা করার জন্য জিদ অশোভন।” অন্যদিকে সুভাষচন্দ্রও উত্তর দিতে কুণ্ঠা বোধ করেননি। তাঁর বক্তব্য ছিল পরিষ্কার। কলেজের কর্তৃপক্ষ কখনই নিজেদের ধর্মবিশ্বাস ছাত্রদের উপর চাপিয়ে দিতে পারেন না। অ্যালবার্ট হলের সভায় তিনি সরাসরি বললেন, “আলোকপ্রাপ্ত এবং অগ্রসর ব্রাহ্ম ভদ্রলোকেরা হিন্দু ছাত্রদের উপর নিজেদের ধর্মবিশ্বাস চাপিয়ে দেওয়ার জন্য এত নিচে কী করে নামলেন, আমি তা অনুধাবন করতে অক্ষম।”
আরও পড়ুন
বাগ-দেবী সরস্বতীর হাত ধরেই সৃষ্টি দণ্ডনীতি বা রাজনীতির
অবশ্য রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্রের সম্পর্ক যে আগেও খুব মধুর ছিল, এমন নয়। কিন্তু সিটি কলেজের সরস্বতী পুজোকে ঘিরে যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হল দুই কিংবদন্তির মধ্যে, তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল সাধারণ বাঙালির মনেও। অবশেষে যদিও রামমোহন ছাত্রাবাসে সরস্বতী পুজো মুলতুবি রইল। কিন্তু পুজোর আয়োজন করার জন্য ৪ ছাত্রকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নিলেন হেরম্বচন্দ্র মৈত্র। দেখতে দেখতে সমস্ত হিন্দু ছাত্র সিটি কলেজ ছেড়ে দিতে লাগলেন। স্বাভাবিকভাবেই টান পড়ল কলেজের অর্থভাণ্ডারে। আর এই সমস্যার শিকার হলেন জীবনানন্দ ও আরও কিছু অস্থায়ী শিক্ষক। জীবনান্দ নিজেও অবশ্য ব্রাহ্ম আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু শোনা যায় ছাত্রাবাসের হিন্দু ছাত্রদের নিজস্ব ধর্মাচরণে বাধা দেওয়ার পক্ষে ছিলেন না তিনি। রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন করেছিলেন, “তাহলে তো মুসলমান ছাত্রদের কুরবানি করিবার অধিকারও দিতে হয়।” হ্যাঁ, সেটাও দিতেই চেয়েছিলেন জীবনানন্দ। একদিকে ধর্মনিরপেক্ষতা, আর অন্যদিকে সর্বধর্মসমন্বয়; এই দুই ভাবনার মধ্যেকার দ্বন্দ্বের মীমাংসা আজও হয়নি। আদৌ কোনোদিন সেই মীমাংসা হবে কি?
আরও পড়ুন
লকডাউনের মধ্যেই ফিরল সরস্বতী নদীর রূপ, সৌজন্যে এক আইপিএস অফিসার
তথ্যসূত্রঃ ভারতে জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ, নেপাল মজুমদার
স্মরণিকা, সিটি কলেজ
সিটি কলেজ, জীবনানন্দের প্রথম কর্মস্থল এবং চাকরিচ্যুতির সূচনা, আমীন আল রশিদ
আরও পড়ুন
লেবুর বীজে সরস্বতী প্রতিমা, নতুন কীর্তি অশোকনগরের শিল্পীর
Powered by Froala Editor