একুশে বিধানসভা ভোটের আগে বিদ্যাসাগরের বন্দনায় মেতে উঠেছে সমস্ত রাজনৈতিক দল। তবে এবারের বিদ্যাসাগরের জন্মদিন বিশেষ উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছে গত বছরের বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার মতো বিতর্কিত ঘটনার নিরিখে। এমনকি বিদ্যাসাগরকে ব্যবহার করে বাংলাভাষীদের মধ্যে যে একটা বিভাজন তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে, সেই গতিপথও বোঝা গিয়েছে স্পষ্ট। সোশ্যাল মিডিয়ায় রীতিমতো প্রচার করা হচ্ছে যে, বাংলা ভাষা থেকে বাংলাদেশি ভাষা পৃথক করে ফেলতে হবে। রক্ষা করতে হবে ‘সনাতনী’ বাংলা ভাষা।
এখন প্রশ্ন হল, সনাতনী বাংলা ভাষা ঠিক কী বস্তু? সোশ্যাল মিডিয়ায় রীতিমতো জোরালো গলায় প্রচার চলছে যে, সনাতনী বাংলা হল সেই বাংলা ভাষা, যেখানে কোনও বিদেশি শব্দের মিশেল নেই। ‘বিদেশি’ বলতে যদিও এখানে মূলত আরবি বা ফার্সি শব্দকেই নিশানা করা হয়েছে। অভিযোগকারীদের বক্তব্য, বিদ্যাসাগর বাংলাভাষাকে যে পথ দেখিয়ে গিয়েছিলেন, সেই পথ থেকে অনেকটাই সরে এসেছে বাংলা ভাষা। শুধু তাই নয়, দিনে দিনে একটি নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বী মানুষেরা সেই ভাষার মধ্যে প্রবেশ করিয়েছে আরবি অথবা ফার্সি ভাষা। ফলে বাংলা ভাষাকে ক্রমশই ‘আরবিকরণ’ বা ‘ফার্সিকরণ’ করার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, এমনই বক্তব্য অভিযোগকারীদের।
যদিও একটি ভাষা গঠন হয় অনেক ভাঙা-গড়ার মধ্যে দিয়েই। এই ভেঙে যাওয়া এবং নতুন করে গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি অবিরাম। একটি বা দু’টি নয়, একাধিক বিদেশি ভাষা নানা ভাবে ক্রমশ মিশে গিয়েছে বাংলা ভাষার সঙ্গে। বাংলা ভাষা কলেবরে যত বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, ততই নতুন নতুন শব্দ ভাণ্ডারে সেজে উঠেছে বাংলা ভাষার সর্বাঙ্গ।
স্বাভাবিকভাবেই কোনো কিছুকে গ্রহণ করতে গেলে একটি ঔদার্যের প্রয়োজন হয়ে থাকে। এবং সেই গঠনগত ঔদার্য ছাড়া কখনোই স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে এগোনো যায় না। আজকে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ মানব গোষ্ঠী যে ভাষায় কথা বলেন, সেটি কিন্তু বাংলা। কিন্তু এই বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যেও এই যে বিভেদ তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে, তার পিছনে লুকিয়ে রয়েছে একটি অন্তর্লীন রাজনীতি। সেই রাজনীতির শিকড় অত্যন্ত গভীরে; এবং বলাবাহুল্য, এই রাজনীতির উদ্দেশ্য ধ্বংসাত্মক। আরও ভয়ের কথা হল, অত্যন্ত সুচতুর ভাবে সেখানে ব্যবহার করা হচ্ছে বিদ্যাসাগরের মতো চরিত্রকে। বিদ্যাসাগরের মতো মহাপুরুষের জন্মদিনে তাঁকে ক্রমশই উপস্থাপন করার চেষ্টা হচ্ছে একজন সমাজ সংস্কারক হিসেবে, যিনি নাকি হিন্দুত্ববাদের জয়গান গেয়েছিলেন!
শুধু তাই নয়, কীভাবে মুসলিম প্রধান দেশগুলির ভাষা প্রয়োগ করে আদতে বাংলা ভাষার সর্বনাশ করতে চেয়েছেন বিভিন্ন মনীষীরা, তাও প্রচার করা হচ্ছে লাগাতার। এবং, সেই যুক্তি শুনলে চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। কারণ, সেখানে এমনকি কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকেও! বলা হয়েছে যে, কাজী নজরুল ইসলাম অত্যন্ত পরিকল্পনা করেই তাঁর রচিত বিভিন্ন গানে এবং কবিতায় যথেচ্ছ আরবি এবং ফার্সি শব্দের ব্যবহার করেছিলেন, যাতে বাংলা ভাষার একটা তীক্ষ্ণ রূপান্তর ঘটানো যায়। এই ধারণা মানুষের মনে আরও গেঁথে দিতে রীতিমতো সতর্কতা বাণীও দেওয়া হয়েছে যে, এই ক্রমাগত বাংলা ভাষাকে বদলে ফেলার প্রক্রিয়া এখনও চালানো হচ্ছে, যাতে ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ে বিদেশী ভাষা বর্জিত সনাতনী বাংলা ভাষা।
এখানে প্রশ্ন তোলাই যায়, শুধু মাত্র আরবি বা ফার্সি ভাষা কেন? ইদানিং যে হারে হাস্যকর ইংরাজি মিশ্রিত বাংলা ভাষার উপদ্রব বেড়েছে, তা কি চিন্তায় ফেলছে না সনাতনী বাংলা ভাষাপন্থীদের? যদিও, বাংলা ভাষার তাত্ত্বিকেরা কিন্তু এটা নিয়ে বড় বেশি চিন্তায়। ‘বাংলাটা ঠিক আসে না’ প্রজন্মের কথা না তুলে হঠাৎ ‘বাংলাদেশী’দের নিয়ে কেন পড়া হল, সেটা বুঝতে তাই অসুবিধা হয় না।
আরও পড়ুন
ধ্রুপদী' ভাষার স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত বাংলা; আত্মবিস্মৃতি নাকি অবহেলা?
রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরকে উল্লেখ করেছিলেন ‘বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী’ বলে। যদিও এর আগে থেকেই বাংলা ভাষা অনেক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বিদ্যাসাগর পরবর্তীকালেও আরও হাজারো পরিবর্তন, পরিমার্জন এবং পরিবর্ধন হয়েছে এই ভাষার। সব সময় যে সেগুলি সমস্ত বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল, তা বলা যায় না। কিন্তু কখনই সেটাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িকতা অথবা জাতিবিদ্বেষ প্রচারের মতো নিন্দনীয় ঘটনা ঘটেনি। বিদ্যাসাগর অবশ্যই এই সবকিছুর ঊর্ধ্বে ছিলেন। তিনি ছিলেন এমন একজন বাঙালি, যিনি সেই যুগে দাঁড়িয়েও হিন্দু সমাজের গোঁড়ামির দিকগুলি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। উঠে-পড়ে লেগেছিলেন সমাজের বুক থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদের কালো দিকগুলি মুছে ফেলতে। তাই শুধুমাত্র ধর্মের গণ্ডিতে মাপা যায় না এমন একটি মানুষকে। বরং বুঝতে শেখা দরকার, ঠিক কী কথা আজীবন বলতে চেয়েছিলেন তিনি। অনুধাবন করা দরকার তাঁর আজীবন মনুষ্যত্বের জয়গান গাওয়ার কথা।
সাবধান হওয়ার সময় তাই এসেছে। এমনকি কোথাও একটা প্রচার করারও চেষ্টা হচ্ছে যে, বাংলা আসলে একটা ‘হিন্দু আরিয়ান’ ভাষা! অর্থাৎ এর ভৌগলিক বিষয়টা সম্পূর্ণ ভাবে বের করে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে মাথার ভিতর থেকে। এবং এর ফলে যে আদতে মদত দেওয়া হচ্ছে বিচ্ছিন্নতাবাদকেই, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। অসুবিধা হয় না যে, আদতে কী ভয়ঙ্কর একটা খেলা চলছে নিচু স্তরে, যার মূল লক্ষ্য হল গোষ্ঠীবদ্ধ একটি ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে ভাঙন ধরানো এবং ধর্মীয় সন্ত্রাসের বীজ ছড়িয়ে দেওয়া সমাজের আরও গভীরে।
প্রাণের বাংলাভাষাকে কেন্দ্র করে হয়ে চলা এই ধরনের নোংরামিকে অত্যন্ত দ্রুত চিনে নিতে হবে বাঙালিদেরকেই। বুঝতে হবে যে, ধর্মের ভিত্তিতে কখনোই ভাষাকে আলাদা করা যায় না। ভাষা একটা আবেগ। এবং যে কোনও ভাষার ক্ষেত্রেই অন্য যে কোনও সংস্কৃতি থেকে আহরণ এবং আরোহন অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। এতে কোনও ভাষা ছোটো হয়ে যায় না। বরং নতুনরূপে দিনে দিনে বিকশিত হতে থাকে। অবিলম্বে বাংলা ভাষা নিয়ে এই সাম্প্রদায়িকতার বীজ বোনা তাই বন্ধ হবে, এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলবে সমস্ত যুক্তিবাদী বাঙালিরা, কে বলতে পারে সেই আশাতেই বুক বাঁধছে না আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষাও?
আরও পড়ুন
অঞ্চলভেদে বদলে যাচ্ছে ভাষার লিঙ্গ, ব্যাকরণ; ভারতের বৈচিত্র্যের ছবিই তুলে ধরে ভাষাতত্ত্ব
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor