স্থানীয় ধানের বীজ-ব্যাঙ্ক গঠন, তিন দশক ধরে লড়াই-এর স্বীকৃতি পেলেন কেরলের কৃষক

ধানের উৎপাদন কীভাবে বাড়ানো যায় ভবিষ্যতে— তা নিয়ে গবেষণা চলছে নিরন্তর। বাজারে আসছে নিত্যনতুন হাইব্রিড ধানের বীজ। তাতে উৎপাদন বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু দেশের বুক থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে বহু ‘নেটিভ স্পিসিস’ বা স্থানীয় প্রজাতির ধান। 

আশির দশকের পর থেকে এই হাইব্রিড বীজের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার কারণেই কেরলের বুক থেকে প্রায় অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল ৫৪টি ধানের প্রজাতি। তার কারণও খুব স্পষ্ট। প্রথমত, হাইব্রিড বীজে ফলন বেশি হওয়ায়, লাভবান হতেন স্থানীয় কৃষকরা। পাশাপাশি সরকারি প্রকল্পে সেইসব বীজ খুব সহজেই পাওয়া যেত কম দামে।

তবে লাভের সম্ভাবনা থাকলেও, হাইব্রিড বীজ চাষের দিকে ঝোঁকেননি তিনি। বরং, ভরসা রেখেছিলেন স্থানীয় বীজেই। শুধু তাই নয়, এর পর শুরু হয়েছিল বিভিন্ন গোত্রের স্থানীয় বীজ সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের এক আশ্চর্য কর্মকাণ্ড। 

চেরুভায়াল রমন (Cheruvayal Raman)। হ্যাঁ, স্থানীয় ধান্যবীজ (Paddy Seeds) সংরক্ষণের এই কর্মকাণ্ড তাঁরই। কেরলের এই দরিদ্র কৃষক এবার এই আশ্চর্য প্রকল্পের জন্যই ভূষিত হলেন পদ্মশ্রী পুরস্কারে। আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগের কথা। নব্বই-এর দশকের শুরুতে বীজ সংগ্রহের এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তাঁর। কেরলের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে তিনি সংগ্রহ করতেন স্থানীয় ধানের বীজ। প্রায় তিন দশকের এই প্রকল্পে সবমিলিয়ে কেরলের ৫৪টি হারিয়ে যাওয়া ধানের বীজকেই নতুন করে আবিষ্কার করেছেন চেরুভায়াল। 

তবে শুধু বীজ সংগ্রহ করলেই তো চলে না। তাদের বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনও আছে বৈকি। আর সেই কারণেই, নিজের ৪০ একর কৃষিজমিতে ধারাবাহিকভাবেই এই ৫৪টি প্রজাতির ধান চাষ করেন চেরুভিয়াল। সেইসঙ্গে তিনি গড়ে তুলেছেন স্থানীয় প্রজাতির ধানের বীজব্যাঙ্ক। সারাবছরই সেখান থেকে বীজ সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে পারেন কৃষকরা। মজার বিষয় হল, চেরুভিয়ালের এই বীজব্যাঙ্ক থেকে বীজ কিনতে অর্থ লাগে না কোনো। বরং, আজও সেখানে চলে বিনিময় প্রথা। চেরুভিয়ালের শর্ত, ধান কাটার পর সমপরিমাণ বীজ কৃষকদের ফিরিয়ে দিয়ে যেতে হবে তাঁর কাছে। তাঁর এই আশ্চর্য প্রকল্প স্থানীয় কৃষকদের মধ্যেও ধীরে ধীরে গড়ে তুলছে সচেতনতা, বীজ সংরক্ষণের দায়িত্ববোধ, নতুন এক কৃষি বাস্তুতন্ত্র।

বর্তমানে কৃষিকাজ ছাড়াও, কেরলের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সদস্য তিনি। জড়িয়ে রয়েছেন ধান্য গবেষণার সঙ্গেও। পাশাপাশি রাজ্য-জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় কৃষকদের সচেতন করতে এবং দেশীয় পদ্ধতিতে উন্নত মানের ফসল চাষের জন্যও নানান কর্মশালা আয়োজন করে প্রবীণ কৃষক। এর আগে এই বিপুল কর্মযজ্ঞের জন্য রাজ্যস্তরে স্বীকৃতি মিলেছিল তাঁর, পেয়েছিলেন একাধিক সরকারি ও বেসরকারি সম্মাননা। এবার ভারত সরকারের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননার মুকুট উঠল তাঁর মাথায়…

Powered by Froala Editor