চারিদিকে ধূ ধূ মরুপ্রান্তর। তার মধ্যেই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে একটি ফুলের গাছ। মরুভূমির সমস্ত রুক্ষতাকে অগ্রাহ্য করে বেয়ারা রকমের ফুলে ভরে উঠেছে গাছটা। ট্রেনের জানলা দিয়ে মুগ্ধ হয়ে সেই দৃশ্য দেখছিলেন এক যুবক। এক বাঙালি যুবক। রবীন্দ্রনাথের আদর্শে দীক্ষিত সেই যুবকের হয়তো মনে পড়ে যাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথেরই লেখা গল্পটির কথা। এই আফগানিস্তান থেকেই প্রতি বছর কলকাতায় যেত সেই কাবুলিওয়ালা। কলকাতার ‘খোঁকী’-কে সে ভালোবেসে ফেলেছিল পিতৃস্নেহে। কিন্তু এদেশের মানুষদের জীবন কেমন? তার প্রায় কোনোকিছুই জানেন না সেই যুবক। আগামী দিনগুলোতে সেই জীবনকেই চিনতে হবে তাঁকে।
১৯২৭ সালে কাবুলে শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে রওয়ানা হয়েছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। সেই চাকরি অবশ্য বেশিদিন করতে পারেননি তিনি। কিন্তু সেই কয়েকবছরের অভিজ্ঞতাকেই সাজিয়ে তুললেন তাঁর কলমে। ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হল তাঁর ভ্রমণকাহিনী ‘দেশে-বিদেশে’। কাবুলের সেই কয়েক বছরের স্মৃতি। তবে সে এক অন্য আফগানিস্তান। চৈনিক পর্যটকদের চেনা ভাবগাম্ভীর্যময় আফগান প্রদেশ তখন তার চেহারা বদলে ফেলছে। তখন থেকেই আফগানিস্তান মধ্যপ্রাচ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চল। একে তো আফগানিস্তানের বুকেও তখন ব্রিটিশ সরকারের আধিপত্য। আবার এর বিরোধী শক্তিরও অভাব নেই। ১৯১৬ সালেই ভারতের বিপ্লবী রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ সিং কাবুলের কাছেই তৈরি করেছিলেন তাঁর নিজস্ব স্বাধীন রাজ্য। তবে সেই রাজত্বও বেশিদিন টেকেনি। আর কাবুলের সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ভারতের ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিকল্পনাও সফল হয়নি। কিন্তু সেই থেকেই কাবুলে বেশ কিছু ভারতীয়ের আনাগোনা শুরু হয়।
মুজতবা অবশ্য চিনতে চেয়েছিলেন আফগানিস্তানের বুকে বেড়ে ওঠা মানুষদের। অভিজাত পস্তুনদের অথবা তথাকথিত নিচু শ্রেণির পঞ্জসেরি তাজিকদের। কাবুলিওয়ালার চেনা ছবির মধ্যেই ফুটিয়ে তুললেন হাজার রঙের বৈচিত্রকে। আর তার মধ্যেই উঠে এল রক্ষণশীল ধর্মীয় নেতা থেকে বিদ্রোহী নেতাদের উত্থানও। বিদেশিদের বিরুদ্ধে আফগানের মানুষের প্রতিরোধের গল্প। এবং তার মধ্যে দিয়ে মুজতবার ভারতে পালিয়ে আসার এক রোমহর্ষক কাহিনি। কয়েক বছর পর আবার সেই সীমান্ত পেরোলেন এক বাঙালি। সঙ্গে একজন মাত্র সঙ্গী। ক্লান্ত মানুষটি সঙ্গীর উদ্দেশে প্রশ্ন করলেন, আর কত পথ বাকি বর্ডার পার হতে? সঙ্গীটি জানালেন, বেশ কিছুক্ষণ আগেই তাঁরা বর্ডার পেরিয়ে এসেছেন। এখন তাঁরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বাইরে। হ্যাঁ, সেই বাঙালি আর কেউ নন, নেতাজি সুভাষচন্দ্র। ভগতরাম তলওয়ার তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলেন কাবুল শহরে।
তখন অবশ্য আফগানিস্তানে বহু ভারতীয়ের বাস। যথাযথ আপ্যায়ন পেলেন নেতাজি। আর এখান থেকেই শুরু হল এক নতুন পথচলা। কাবুলে রুশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে রাশিয়ার সাহায্য চাইলেন সুভাষ। কিন্তু সেখান থেকে কোনো উত্তরই পাওয়া গেল না। এদিকে জার্মানি সাহায্য করতে প্রস্তুত। কিন্তু বার্লিন থেকে অন্তিম নির্দেশ আসছে না কিছুতেই। এদিকে চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে ব্রিটিশ গুপ্তচর। মরিয়া সুভাষ যখন সীমান্ত পেরিয়ে রাশিয়ায় পৌঁছে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন, তখনই খবর এল ইতালি থেকে সাহায্যের ডাক এসেছে। নেতাজির লড়াইয়ের মোড় ঘুরে গেল এক লহমায়। ব্রিটিশ শক্তিকে হারাতে তিনি তখন যে কোনো শক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে প্রস্তুত।
আরও পড়ুন
তালিবানি আগ্রাসনের মধ্যেই শান্তির স্বপ্নে বুঁদ আফগানিস্তানের মহিলা সাংবাদিক
কাবুল, আফগানিস্তান আর কাবুলের কাছেই জালালাবাদ – এইসব এলাকার সঙ্গে একটু একটু করে পরিচিত হচ্ছিলেন ভারতীয়রা। অবশ্য জালালাবাদের কাছে বেলুচের হিংলাজমাতার মন্দির তো এক প্রসিদ্ধ তীর্থস্থান। কিন্তু এই দুর্গম পথ বেয়ে সেখানেও খুব কম বাঙালিই যেতেন। হিংলাজ তীর্থের সেই অভিযানকে বাঙালির কাছে দৃশ্যমান করে তুলেছিলেন কালিকানন্দ অবধূত, তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’-এ। বেলুচ এবং বৃহত্তর কাবুল অঞ্চলের বহু জায়গাই তিনি ঘুরেছেন পায়ে হেঁটে। তবে সেসবের অনুপুঙ্খ বর্ণনা সব লিখে যাননি। এর বহু বছর পর ১৯৮৮ সালে কলকাতা থেকেই কাবুলের বুকে যাত্রা করলেন এক বাঙালি তরুণী। সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দেশভ্রমণের নেশায় নয়, বরং ভালোবাসার টানে। রাশিয়ার সামরিক বাহিনী এবং মুজাহিদিন গোষ্ঠীর বিরোধে তখন আফগানিস্তান রীতিমতো জ্বলছে।
আরও পড়ুন
কাবুল দখলের পথে তালিবানরা, ৯০ দিনে আফগান সরকার পতনের আশঙ্কা
সেই শ্বশুরবাড়ি থেকে আবার পালিয়েও এলেন ১৯৯৫ সালে। ততদিনে মুজাহিদিন গোষ্ঠীর ভিতর থেকে তালিবানদের জন্ম হয়ে গিয়েছে। প্রথমবারের পালানোর পরিকল্পনা ব্যর্থ হল। পাকিস্তান সীমান্ত অবধি এসে ধরা পড়ে গেলেন সুস্মিতা। শ্বশুরবাড়িতে বন্দি হলেন। আবার সেই ঘরে সুড়ঙ্গ কেটে পালানো। আবারও তালিবানদের হাতে ধরা পড়লেন। বন্দিত্ব। কিন্তু সেই বন্দিদশা থেকে নিজেই পালানোর পথ খুঁজে নিলেন। কলকাতায় ফিরে সেই সমস্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখলেন ‘কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ’। আফগানিস্তানের এক অন্য চেহারার সঙ্গে পরিচয় হল বাঙালির। এরপর মার্কিন সামরিক শাসনের থাকা তালিবান আধিপত্যমুক্ত আফগানিস্তানের ছবি খুঁজতে আবারও ফিরে গিয়েছিলেন সুস্মিতা। বলেছিলেন, আবারও নতুন অভিজ্ঞতার কথা লিখবেন তিনি। কিন্তু বছরখানেক থাকার পরেই ২০১৩ সালে তালিবান বাহিনীর হাতে খুন হলেন সুস্মিতা। শরীরে গেঁথে গেল ২০টি বুলেট। এমনকি নৃশংস হত্যাকারীরা সুস্মিতার মাথার চুল পর্যন্ত ছিঁড়ে ফেলেছিল।
আরও পড়ুন
বিনা বাধায় আফগান শহর দখল, তালিবানদের অগ্রগতিতে আশঙ্কার মেঘ
আফগানিস্তানের আজকের পরিস্থিতির পিছনে রয়েছে ১০০ বছরের নানা উত্থান-পতনের ইতিহাস। আর সেই সমস্ত ইতিহাসের সাক্ষী থেকেছেন বাঙালিরাও। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে যে কাবুলিওয়ালাকে আমরা চিনেছি ছোটোবেলায়, তাদেরই নানা বৈচিত্র কখনও বিস্মিত করেছে, কখনও মুগ্ধ করেছে। আবার ভিতরে ভিতরে জমেছে আশঙ্কাও। আশঙ্কা আফগানদের জন্যও। তাঁরাও তো বাঙালিদের আত্মীয়তার বন্ধনে বাঁধতে কার্পণ্য করেননি কোনোদিন।
Powered by Froala Editor