১৮৪৬ সালের ৩০ জুন। লন্ডনের লেট নাইট পার্টিতে তখন রীতিমতো অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন দ্বারকানাথ। সমস্ত পার্টিতেই থাকে বিলাসিতার অঢেল আয়োজন। এমনই এক পার্টিতে হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এরপর এল ৩১ জুলাইয়ের সেই কালরাত্রি। সমগ্র লন্ডন শহরে সেদিন অবিশ্রান্ত বারিধারা ঝরে পড়ছে, টানা দুদিনের বৃষ্টিতে জলমগ্ন সমগ্র লন্ডন। প্রকৃতির সমস্ত রোষ যেন সেদিন একনাগাড়ে বর্ষিত হচ্ছিল লন্ডনের ওপর। এই রাতেই ঘটে গেল মহীরুহ পতন। চিরদিনের মতো না ফেরার দেশে চলে গেলেন দ্বারকানাথ।
দ্বারকানাথ মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরবাড়িতে শুরু হল একের পর এক বিপর্যয়। যে দ্বারকানাথ এতদিন ছিলেন বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক তার উত্তরসূরীরা কেউই বিচক্ষণতার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের হাল ধরতে পারেননি। অন্যদিকে দ্বারকানাথের মৃত্যুর পরেই তাঁদের জ্ঞাতিদের মধ্যে দ্বারকানাথের শ্রাদ্ধ-শান্তির বিষয়ে প্রবল অশান্তি শুরু হল। একদল বলতে থাকলেন দ্বারকানাথ ঠাকুরকে বিলেতে সমাধিস্থ করা হয়েছে, তার মরদেহ লন্ডন থেকে কলকাতায় এনে শ্রাদ্ধ-শান্তি করা হোক। যা তৎকালীন সময়ে ছিল অসম্ভব। তখন দ্বারকানাথের এক ভাই রমানাথ ঠাকুর বলেন, দ্বারকানাথের মরদেহ আনা যখন সম্ভব নয় তখন কুশপুত্তলিকা দাহের মাধ্যমে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হোক। এ-সম্পর্কে সুমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা থেকে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। তিনি লিখছেন - "দ্বারকানাথের শ্রাদ্ধ শান্তি কী ভাবে হবে তাই নিয়ে আমাদের পরিবার ও জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে এক বিরাট সমস্যা দেখা দিল। জ্ঞাতিবর্গ দ্বারকানাথের শ্রাদ্ধ নিয়ে দুটি দলে বিভক্ত হলেন এবং দু'রকম বিধান দিলেন...।"
তবে বিরোধের এখানেই শেষ নয়। দেবেন্দ্রনাথ হঠাৎ গোঁ ধরে বসেন তিনি বইডিকমতে দ্বারকানাথের শ্রাদ্ধ-শান্তি করবেন যা পাথুরিঘাটার জ্ঞাতিদের পছন্দ হয়নি। এই ঝামেলায় প্রবল আকার গ্রহণ করে শ্রাদ্ধের পর গঙ্গা অভিমুখে শোভাযাত্রার সময়। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই শোভাযাত্রায় থাকেননি, ফলে চরম অপমানিত হলেন অন্যান্য জ্ঞাতিভাইরা।
এই বিরোধের জল শেষপর্যন্ত অনেকদূর গড়িয়েছিল। জোড়াসাঁকোর এবং পাথুরিঘাটার দুই পরিবারের মধ্যে মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে যায় এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে, বন্ধ হতে বসে পারিবারিক কারণে নিমন্ত্রণাদি। এমনকি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে অন্যান্য জ্ঞাতিরা মেছোবাজারের পেয়াঁজ-রসুন খাওয়া বাড়ি বলে অভিহিত করতে শুরু করে।
দ্বারকানাথের মৃত্যু এবং সেই মৃত্যুকে কেন্দ্র করেই দুই পরিবারের মধ্যে বিরোধ শেষ পর্যন্ত ঠাকুর পরিবারের মধ্যে পাঁচিল তুলে দিল। অন্য অনেক ঘটনার মতো এও দ্বারকানাথের জীবনের এক ট্র্যাজেডি, মৃত্যুর পরেও যাঁর শ্রাদ্ধশান্তি নিয়ে বিভক্ত হয়ে যায় ঠাকুর পরিবার।
তথ্যসূত্র - 'ঠাকুরবাড়ির জানা অজানা' - সুমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর
আরও পড়ুন
ছিলেন ৪৩টি বেশ্যালয়ের মালিক, সোনাগাছির সঙ্গেও জড়িয়ে তাঁর নাম; দ্বারকানাথের অন্য ব্যবসার গল্প
Powered by Froala Editor