২৩ মে
রায়দিঘি, সুন্দরবন
ঝড়ের পরে তৃতীয় দিন।
সুন্দরবন আবার ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠছে। মানুষগুলো যেন হারতে শেখেনি। ঝড়ের পরে পাওয়া খবর অনুযায়ী, রায়দিঘি অঞ্চলের মধ্যে জয়নাল, কঙ্কনদিঘি, রায়দিঘি, ক্যাওড়াখালি যেসব জায়গায় ছোটো বড়ো নদী বাঁধ ভেঙেছিল তার বেশিরভাগ বাঁধ গ্রামের লোকেরা নিজেরাই দায়িত্ব নিয়ে সারিয়েছে এবং এখনো কিছু জায়গায় কাজ চলছে, দু-তিনটে বাঁধ যা হোক করে মাটি ফেলে কোনওরকমে জল আটকে রাখা হয়েছে। বাঁধগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ কারণ সবই কাঁচা মাটি দিয়ে, বৃষ্টি হলে বা পরের কোটালে এমনিতেই আবার সব ভেঙে যাবে।
নদী তীরবর্তী অঞ্চলসহ সমগ্র রায়দিঘি অঞ্চলের চিত্র বলতে, রাস্তা ভর্তি ইলেকট্রিক পোস্ট পড়ে, গাছ পড়ে, গাছগুলো কেটে কেটে গ্রামের লোক রাস্তার ধারে সরিয়ে রেখেছে, গাছ কাটার জন্য সরকারি তৎপরতা এখনও চোখে পড়েনি। নদীর তীরবর্তী অঞ্চলগুলো বাদ দিলেও জনার্দনপুর, কম্পানিরঠেক, কাশীনগর, কৌতলা প্রভৃতি গ্রামের মত নদী থেকে দূরবর্তী গ্রামগুলোতেও কোথাও একটা ইলেকট্রিক পোস্টে হাত দেওয়া হয়নি। গ্রামের ভেতরের ইলেকট্রিক পোস্ট বাদ দিলেও, মেন রাস্তাতেও কিছু করা হয়নি, যেগুলো ভেঙে রাস্তা আটকে ছিল সেগুলো গ্রামের লোকেরা নিজেরাই কোনোরকমে সরিয়ে রাস্তাটুকু বার করেছে।
কেউ যদি রিলিফের জন্য যাওয়ার কথা ভেবে থাকেন, তাদের সাবধান করে বলি, কোনো বড়ো গাড়ি ভিতরের অঞ্চলগুলোতে ঢুকবে না, এমনিতেই সরু পিচের রাস্তা, পাশাপাশি দুটো ভ্যান যেতে পারে না, তার উপর রাস্তা আটকে ইলেকট্রিক তার, গাছের হেলেপড়া গুঁড়ি। সব মিলিয়ে কোনো রাস্তায় ঢোকার আগে গ্রামবাসীর ইনস্ট্রাকশন ছাড়া ঢুকবেন না, একবার ঢুকে গেলে গাড়ি ব্যাক করা যাবে না। স্থানীয় কোনো ব্যক্তি, ক্লাব বা অন্য কোনো সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে রিলিফের কাজ না করলে সমস্যা হতে পারে।
ব্যবসায়ীরা, বিশেষত ছোটো দোকান ব্যবসায়ীরা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত, বাড়িসহ দোকানের অধিকাংশ ভেঙে গেছে। ছোট ব্যবসায়ীরা, মূলত যারা রায়দিঘি, কম্পানীরঠেক, কাশীনগর প্রভৃতি বড় বাজার থেকে পাইকারি বাজার করে গ্রামে নিয়ে ব্যবসা করে। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হওয়ায় বাজার দূরবর্তী গ্রামগুলোতে বিভিন্ন পণ্য সামগ্রীর অভাব আছে।
প্রচুর ঘর ভেঙেছে, সেসব জোড়াতালি দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে, বাড়ির বাবা ছেলে মা মেয়ে সবাই মিলে পুরনো বাঁশখুঁটি, ত্রিপল যা ছিল পুরনো, এসব দিয়ে কোনোরকমে যেটুকু অবশিষ্ট সেগুলো থাকার মতো করছে। সরকারি মিনিমাম সাহায্য এখনো পৌঁছোয়নি। গ্রামের পঞ্চায়েত অফিসের সামনে প্রচুর লোক বসে আছে শুধুমাত্র একটা ত্রিপলের জন্যে।
নেটওয়ার্কের সমস্যা এখনও একইরকম। গ্রামের লোকেরা জেনারেটরের ব্যবস্থা করেছে কোথাও কোথাও, ফোনে চার্জ দেওয়ার জন্য যাতে বাইরে থাকা বাড়ির অন্য লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। এখনও বহু পরিবার আছে এমন যাদের বাইরে থাকা আত্মীয় স্বজনেরা এখনও বাড়ির লোকের বাঁচা-মরার খোঁজটুকু পায়নি।
রায়দিঘিসহ বহু প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোনও NGO চোখে পড়ার মত কাজ করছে না। কিছু NGO স্থানীয় ক্লাবে টাকা দিচ্ছে। বাইরে থেকে গিয়ে এই NGO-গুলোর কাজ করার তেমন স্কোপও নেই।
অতএব, সৌভাগ্যক্রমে আপনারা যাঁরা সুস্থ স্বাভাবিক আছেন, এবং এমন বিপুল বিপর্যয়ের আঁচটুকু গায়ে লাগা তো দূরের কথা, এর ভয়াবহতা কল্পনাও করতে হয়নি, তাঁরা একটু ভাবুন, আর কতবার ওই মানুষগুলো সব হারিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াবে, তাও শুধুমাত্র নিজেদের চেষ্টায়! একেকটা ঝড় আসে, সব নিয়ে যায়। তবু এখনও সুন্দরবনে হাজার হাজার কাঁচা বাড়ি, টালির চাল, মাটির বাঁধ... অবাক লাগে না?
আপনারা প্রতিটা ঝড়ের পরে কয়েকদিন রিলিফ দিয়ে দিয়ে সুন্দরবন বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন তো?
Powered by Froala Editor