দরিয়াপুর ডোকরাপাড়া। পূর্ব বর্ধমান জেলার ছোট্ট এক জনবসতি। বহুকাল আগে কয়েকজন ভিনরাজ্য থেকে এখানে এসেছিলেন উপার্জনের আশায়। দরিয়াপুরের একটা পুকুরপাড়েই অস্থায়ীভাবে কাটত দিন। তৎকালীন সরকার হস্তক্ষেপ করে তারপর। তৈরি হয় স্থায়ী নিবাস। শিল্পীর পাড়া।
গুসকরা স্টেশন থেকে কয়েক মিনিট এগোলেই পড়বে দিগনগর ২ নং গ্রাম পঞ্চায়েত। তার সামনেই এই ডোকরাপাড়া। বড়জোর ৪০-৪৫ ঘর মানুষের বসবাস। অন্য রাজ্য থেকে এলেও, এখানে থাকতে থাকতে বাংলা শিখে নিয়েছেন রীতিমতো। পদবি ‘কর্মকার’। কাজের জন্যেই। আগে কী ছিল, তা অবশ্য জানা যায় না আর। পড়াশুনাও এগোয়নি বেশিদূর। কিন্তু তাঁদের মূল পরিচয় কী?
শুনলে অবাক হবেন, এঁরা প্রত্যেকেই একেকজন উঁচুমানের ডোকরা শিল্পী। পিতল গলিয়ে, মোম ঢালাই পদ্ধতিতে একের পর এক জিনিস – মূর্তি, জুয়েলারি, শো পিস ইত্যাদি তৈরি করেন তাঁরা। নিখুঁত সেই শিল্প দেখে অবাক হতে হয়। কীভাবে বছরের পর বছর ধরে এই কাজে নিয়োজিত আছেন একটি গোটা পাড়ার বাসিন্দারা, তা এক বিস্ময়। সূদূর ফ্রান্স, ইতালি, প্যারিস থেকে মানুষজন ছুটে আসেন তাঁদের এই শিল্প দেখতে। কিন্তু আদতে কেমন আছেন তাঁরা?
এর উত্তর সহজেই অনুমেয়। আর পাঁচটি শিল্প সাধারণত যে ‘সম্মান’ পায় এ-রাজ্যে তথা দেশে, ডোকরা শিল্পের অবস্থা তার থেকে আলাদা কিছু নয়। বরাবর বঞ্চিত ও শোষিতই হয়ে এসেছেন তাঁরা। দেশ-বিদেশ থেকে মানুষজন আসে, ছবি তোলে, প্রশংসা করে চলে যায়। কিন্তু আদতে কতটা অর্থনৈতিক লাভ হয় শিল্পীদের? রাজ্য সরকারের তরফ থেকে কিছু চেষ্টা করা হয়েছে। তৈরি হয়েছে শিল্পচর্চার জন্য নতুন বিল্ডিং। সেই বিল্ডিং-এ রয়েছে ঝকঝকে গেট, আলোর কারুকার্য। তৈরি হয়েছে কো-অপারেটিভও। বছরে একবার করে ডোকরা মেলা, প্রদর্শনী, এনজিও-র আনাগোনা – ইত্যাদিও চলছে পাশাপাশি। কিন্তু এতে শিল্পীদের কি সত্যিই উপকার হচ্ছে?
বাইরের দেখনদারি সরিয়ে ভিতরে উঁকি দিলে কিন্তু দেখা যায় অন্য দৃশ্য। বাবুদের অর্ডার সাপ্লাইয়ের জন্যে রাতের পর রাত জেগে চুল্লির আগুনের সামনে বসে কাজ করে চলেছেন রামু কর্মকার, বিশু কর্মকাররা। সেঁকে নিচ্ছেন হাতের চামড়া, মুখের ত্বক। হয়তো ভাগ্যও। পাশে বাংলা মদের বোতল। ক্লান্তিতে সেই পানীয়ই তাঁদের ‘শক্তি’ জোগায়। এভাবেই বেশ কেটে যায় সময়, চলে যায় পেট।
কিন্তু হঠাৎই কারো কারো বুকে ব্যথা, মুখ থেকে বের হয় দলাদলা রক্ত। অসুখের সার্টিফিকিটে লেখা হয়ে লাংস কার্সিনোমা। কিন্তু কেন, এমনটা তো হওয়ার কথা নয়? তাঁরা নিদারুণ পরিশ্রম করেন, তাঁদের শিল্পকর্মের বাজারমূল্যও নেহাৎ ফেলনা নয়। তাহলে এমন কেন পরিস্থিতি?
রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার পাওয়া শিল্পী বিশু কর্মকার জানান –‘লাভ নেই, যা পরিশ্রম করি সে অনুপাতে পারিশ্রমিক পাই না। লাভের গুড় পিঁপড়েতেই খায়।’ একজন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত ডোকরা শিল্পী যখন বলেন সঠিক শ্রমের সঠিক মজুরি নেই এ-শিল্পে, তখন সত্যিই অবাক লাগে। অথচ ডোকরার বাজারমূল্য আবার বিপরীত কথা বলে। তার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেল, এই শিল্পীরা সামাজিকভাবে ততখানি শিক্ষিত নন, ফলে তাঁরা নিজেরাও জানেন না তাঁদের শিল্পকর্মের মূল্য কেমন। কিছু দালালের হাত ধরেই নিয়ন্ত্রিত হয় বাইরের বাজার। সেসব দালালরা বাজার অর্ডার নিয়ে আসে চড়া দামে, তারপর শিল্পীদের নামমাত্র পয়সা দিয়ে কাজ করিয়ে বাকি টাকা রেখে দেয় নিজেদের কাছেই। এর প্রধান কারণ এই শিল্পীদের সামাজিক ও বাজারমূল্য সম্পর্কে অজ্ঞতা।
এই সুযোগে কখনও কোনো সমাজসেবী, কখনও আবার চলচ্চিত্রকার, ফটোগ্রাফার, সামাজিক গোষ্ঠী ইত্যাদিরা নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে এই ডোকরা শিল্পীদের ভাঙিয়ে। আর শিল্পীরা পড়ে রয়েছেন যে তিমিরে, সেই তিমিরেই।
আর সে-জন্যেই শিল্পী যোগ্য মর্যাদা পান না। রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েও, ফারাক করতে পারেন না আগের আর পরের জীবনের মধ্যে। তবে এ-শুধু ডোকরা শিল্পীদেরই অবস্থা নয়, প্রায় সব মাধ্যমের প্রকৃত শিল্পীরাই এই পরিস্থিতির শিকার। ‘বাজার’ বড় বিষম বস্তু। তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য নিজেদের তৈরি না করতে পারলে, ‘শিল্প’ যে দুটি অক্ষরের গণ্ডির বাইরে বেরোতে পারে না বেশিরভাগ সময়ই, তার অন্যতম উদাহরণ এই ডোকরা শিল্পীরাই।