ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির যে সমস্ত নিচু স্তরের কর্মচারীকে ভারতে পাঠানো হত, তাঁদের কাছে সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় ছিল এদেশের উষ্ণতা। বিশেষ করে ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের ব্যবসার ক্ষেত্র বলতে তখন বাংলাই। স্থানীয় মানুষদের চোখে এখানকার জলবায়ু যতই স্নেহ-শীতল মনে হোক, সাদা চামড়ার ইংরেজদের কাছে তা ছিল অসহ্য। অথচ ব্যবসা করতে গেলে তো এখানে থাকতেই হবে। তাহলে উপায় কী?
উপায় পাওয়া গেল বাংলার জনজীবন থেকেই। বাঙালিদের নিজস্ব ধরণের ঘর, যাকে বলা হয় চালা ঘর। না, তা মোটেও আজকের অবহেলিত চালা ঘরের পর্যায়ে পৌঁছয়নি তখনও। বরং দো-চালা থেকে আট-চালা পর্যন্ত বিচিত্র সব চালা-স্থাপত্য দেখলে অবাক হতেই হত। সামান্য খড় অথবা শনের কাঠি দিয়ে এমন ছাদ বানানো যায়? আর সত্যিই সেইসব ঘরে ঢুকলে যেন শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। তবে এই গল্প মোটেও চালা-স্থাপত্যের গল্প নয়। বরং বলছি একেবারে সাহেবি এক স্থাপত্যশৈলির কথা। আজও ইংরেজ শাসনের ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দীপ্রাচীন সব বাংলো। যেন ইংরেজরাই নিয়ে এসেছিল বাড়ি তৈরির এই বিশেষ ধারা। কিন্তু এর মূল কিন্তু বাংলার চালা-স্থাপত্যের মধ্যেই।
ভাষাবিদদের মতে ‘বাংলো’ শব্দটি এসেছে গুজরাটি ‘বাঙ্গালো’ শব্দ থেকে। যার অর্থ বাঙালি জাতি। বাংলার ঘরের আদলে তৈরি হত এই বাড়ি। তাই তার নাম বাংলো। অষ্টাদশ শতকের শুরু থেকেই ব্রিটিশ নির্মাণকর্মীরা এই শৈলি আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন। তখনও রাজ্যপাট প্রতিষ্ঠিত না হলেও বাণিজ্যিক সনদ পেয়ে গিয়েছেন ব্রিটিশরা। ফলে গ্রামগঞ্জের নানা জায়গায় তাঁদের বাসা বেঁধে থাকতে হত। চাষ-আবাদ পরিচালনা করতে হত। এই সময় থেকেই শুরু হয় বাংলো তৈরির রেওয়াজ। চারদিক খোলা বাড়ি। সাধারণত দুটি বা তিনটি প্রশস্ত ঘর। সঙ্গে একটি রান্নাঘর এবং মূল বাড়ি থেকে কিছু দূরে একটি কলঘর। আর বাড়ির চারদিক ঘিরে থাকত প্রশস্ত বারান্দা। মূলত এই হল বাংলো বাড়ির কাঠামো। সিঁড়ির কোনো বালাই নেই। মূল ভবনের মাথায় থাকত একটি চারদিকে ঢালু ছাদ। আর বারান্দার জন্য অপেক্ষেকৃত নিচু একটি ছাদ। অর্থাৎ দো-চালা বাড়ির কাঠামো থেকেই অনুপ্রাণিত ছিল বাংলো বাড়ি। তবে অনেক ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের বাড়িগুলির আদলে বাড়ির মাথায় থাকত স্কাই-লাইট।
বাংলার নিজস্ব জলবায়ুর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্যই তৈরি বাংলো কাঠামো। কিন্তু স্বল্পতার মধ্যেই তার বিলাসবহুল সৌন্দর্য মুগ্ধ করেছিল অনেককে। ইংরেজদের অন্যান্য উপনিবেশে তো বটেই, এমনকি খোদ ইংল্যান্ডেও বহু মধ্যবিত্ত বাংলো আদলে বাড়ি বানাতে শুরু করে দিলেন। সেখান থেকে জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছিল আমেরিকাতেও। এর মধ্যেই এসে পড়ল পলাশির যুদ্ধ। আর রাজ্যপাট হাতে নেওয়ার পরেই কোম্পানি শাসকরা জোর দিলেন নীলের চাষে। এই সময় থেকেই বাংলো বাড়ির চাহিদা বাড়তে থাকে। কারণ নীল চাষীদের উপর নজর রাখার জন্য কুঠি তৈরি করে থাকতে হত খোদ ইংরেজ সাহেবদেরই। সেইসঙ্গে ব্যাপক লুণ্ঠন ও অত্যাচারের কথা তো আলাদা কিংবদন্তি।
আরও পড়ুন
প্রাতিষ্ঠানিক বাংলার ‘আস্ফালন’, কোণঠাসা পশ্চিমবঙ্গের মৌখিক ভাষাবৈচিত্র্যও?
এদেশে ইংরেজদের প্রশাসনিক ক্ষমতা যত বেড়েছে, ততই বেড়েছে বাংলো বাড়ির চাহিদা। গ্রামে গ্রামে ব্রিটিশ কর্মচারী এবং তাঁদের প্রিয়জনদের জন্য তৈরি হতে থাকে ডাক-বাংলো। তবে শুধুই যে ব্রিটিশরা বাংলো বাড়িতে থাকতেন, তা কিন্তু নয়। বাঙালি মধ্যবিত্তদের মধ্যেও বাংলো বাড়ি হয়ে উঠেছিল আভিজাত্যের প্রতীক। উনিশ শতকের শেষদিকে কলকাতা শহরতলি, বিশেষ করে ব্যারাকপুর অঞ্চলের অধিকাংশ বাড়িই ছিল বাংলো কাঠামোর। বলা বাহুল্য, এইসব বাড়িতে বাঙালিরাই থাকতেন। এমনকি পাহাড়ে তাঁদের ছুটি কাটাতে যাওয়ার জন্য তৈরি বাড়িগুলিও হত একই আদলের। ১৯১১ সালে কলকাতা থেকে রাজধানী সরে যায় দিল্লিতে। এরপর উত্তর ভারতেও বাংলো বাড়ির সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকে। আজও সিমলা, নৈনিতাল বা গাড়োয়াল অঞ্চলে সেই সময়ের সাক্ষী হয়ে আছে বহু বাংলো যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চেহারায় কিছুটা বদল এসেছে। বিশেষ করে আগের মতো বড়ো জায়গা তো আর বিশ শতকে পাওয়া যেত না। ফলে চারদিক ঘেরা বারান্দার বদলে শুধুই বাড়ির সামনে প্রশস্ত বারান্দা রাখা হত।
আরও পড়ুন
দাম প্রায় ৯৫,০০০ টাকা; অভিনব এই বাংলা উপন্যাস ছাপা হবে মাত্র ১৭ কপি!
কিন্তু ঠিক কী কারণে বাংলার দো-চালা বাড়ির এমন বিশ্বজোড়া প্রভাব পড়ল? তার কারণ অবশ্যই এই বাড়ির শীততাপ নিয়ন্ত্রক ক্ষমতা। হয়তো খড় বা শনের কাঠি দিয়ে ছাউনি তৈরি সহজ ছিল বলেই বাঙালিদের বাড়ির ছাদ সমান্তরাল না হয়ে হেলানো হত। কিন্তু এর ফলেই নিয়ন্ত্রণে থাকত ঘরের উষ্ণতা। সূর্য যখন মধ্যগগনে থাকত, তখনও বাড়ির মাথায় তার আলো এসে পড়ত তির্যকভাবে। কারণ ছাদটাই যে হেলানো। তাছাড়া বাড়ির মূল ছাদ এবং বারান্দার ছাদ আলাদা হওয়ায় সেই ফাঁক খানিকটা ইন্সুলেটরের কাজও করত। আর চারদিক খোলা থাকায় যে সারাদিন, সারা বছর ঘরে হাওয়া খেলা করত, সে-কথা বলাই বাহুল্য। এতসব কারণেই সারা পৃথিবীর মানুষ আপন করে নিয়েছিলেন এই কাঠামো। শুধু বাঙালিই তার নিজস্ব জীবন ছেড়ে এসেছে। আজকাল বাক্স আকারের বাড়িতে গরমে হাঁসফাঁস করলে আমরা ঘরে এয়ার কন্ডিশনিং যন্ত্র কিনে আনি। তাতে পরিবেশ আরও বেশি দূষিত হয়ে ওঠে। অথচ গরমের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় আবিষ্কার করেছিলেন বাঙালিরাই। আজও বেশ কিছু জায়গায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে কিছু বাংলো বাড়ি। সেগুলো কি ইংরেজ শাসনের চিহ্ন? নাকি বাঙালির হারানো সংস্কৃতির নমুনা? কোনটা বললে সঠিক হবে?
আরও পড়ুন
বাংলায় বর্গি আক্রমণ এবং তাঁতিদের একটি গ্রাম গড়ে ওঠার গল্প
তথ্যসূত্রঃ The origin and indigenisation of the Imperial bungalow in India, MIKI DESAI AND MADHAVI DESAI, The Architectural Review
Powered by Froala Editor