১৯৩০ সালের ফেব্রুয়ারির পরের ঘটনা। ততদিনে (১৯৩১ সাল) চলচ্চিত্র নির্মাতা বীরেন্দ্রনাথ সরকার কলকাতায় একটি চলচ্চিত্র কোম্পানি গঠন করেছেন। নাম ‘নিউ থিয়েটার্স’। এটি প্রথম দিকের চলচ্চিত্র কোম্পানিগুলোর অন্যতম। পরিচালক নীতিন বোস এর ব্যানারে বাংলা ছবি বানাচ্ছিলেন। ছবির নাম ‘ভাগ্যচক্র’। খুব সম্ভবত ১৯৩৪ সালের দিকে মুক্তি পায় ছবিটি। ১৯৩৫ সালে এই ছবি বাংলার পাশাপাশি হিন্দিতে ‘ধূপ-ছাঁও’ নামে রিলিজ করে। এদিকে, নীতিন বোস স্টুডিয়ো যাওয়ার সময় বন্ধু এবং গায়ক-সুরকার পঙ্কজ মল্লিককে তাঁর বাড়ি থেকে নিয়ে যেতেন। প্রায় প্রতিদিনের রুটিন এটা। পঙ্কজ মল্লিক (Pankaj Mullick) নিজেই তাঁর আত্মজীবনীতে এ কথা লিখেছেন।
একবার নীতিন বোস গাড়ি নিয়ে পঙ্কজ মল্লিকের বাড়ি পৌঁছলেন। পঙ্কজবাবুকে নেবেন। যথারীতি হর্ন বাজালেন। একাধিকবার। বাইরে এলেন না পঙ্কজ। শব্দ শুনে বাবা মণিমোহন মল্লিক জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে নীতিনকে ইঙ্গিত করে জানালেন, পঙ্কজকে পাঠাচ্ছেন। মণিমোহন ঘরে গিয়ে দেখলেন চোখ বন্ধ করে চেয়ারে বসে মগ্ন হয়ে কিছু শুনছেন তাঁর পুত্র। ‘নীতিন যে নিচে অপেক্ষা করছে। বহুক্ষণ ধরে হর্নও বাজাচ্ছে।’ একথা শুনে পঙ্কজ দৌড়ে নিচে নেমে নীতিনকে বলেন, ‘ক্ষমা করো ভাই, আজ আমি কোথাও হারিয়ে গেছি।’ কিন্তু কী এমন হল যে, এত জোরে হর্নও শুনতে কানে পৌঁছল না পঙ্কজবাবুর? আসলে তিনি প্রিয় এক ইংরেজি গানের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছিলেন। ফলত কিছুই শুনতে পাননি।
পঙ্কজের উত্তর শুনে নীতিন সাহেবের মনে একটা ভাবনা খেলে যায়। পঙ্কজ যদি শুনতে শুনতে তার পছন্দের গানের সঙ্গে গাইতে পারেন, তাহলে একই কৌশল কেন চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা যাবে না? এই প্রশ্নই ঘোরাফেরা করতে থাকে। অর্থাৎ ভালো গায়কের কণ্ঠে গানটি আগে থেকেই রেকর্ড করা উচিত। তারপর ছবিতে নায়ক-নায়িকার লিপের প্রশ্ন। তখন চলচ্চিত্রের কুশীলবরাই গান গাইতেন। আর ক্যামেরার সামনে শুটিংয়ের পাশাপাশি থাকত গান-বাজনা। এ কারণেই নায়ক-নায়িকা হিসেবে যাঁকেই বাছাই করা হবে, তিনি অভিনয়ের পাশাপাশি ভালো গান গাইতে পারেন কিনা, সে-কথাও মনে রাখতে হত চলচ্চিত্র নির্মাতাদের। তাই লিপ সিঙ্কের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা সহজ ব্যাপার ছিল না।
নীতিন বোস এ-ব্যাপারে প্রথমে পঙ্কজবাবুর সঙ্গে পরামর্শ করেন। তারপর স্টুডিয়োয় ছবির সংগীত পরিচালকের সঙ্গেও এ বিষয়ে কথা বলেন। তাঁরও খাসা লাগে পরিকল্পনাটি। কারণ ছবির শুটিংয়ের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে অন্যদের সুর, তাল, লয় মেলাতে অসুবিধার মধ্যে পড়তে হত। এছাড়াও, একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রী যদি গান গাইতে না জানতেন, তবে তাঁকে প্রথমে কয়েক সপ্তাহ বা মাস ধরে গান শেখাতে হবে। সে তো আরো বড় সমস্যা। তাই নীতিন বোসের এই ভাবনায় তিনি সমস্যার সমাধান খুঁজে পেয়ে তাতে সায় দেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে। কৃষ্ণচন্দ্র দে-র কণ্ঠে ছবির জন্য একটি গান রেকর্ডও হয়।
আরও পড়ুন
বাবার আপত্তি সত্ত্বেও গানকেই জীবন হিসেবে বেছে নেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
গানটি ছিল, ‘ম্যায় খুশ হোনা চাহু, খুশ হো না সাকু’। এতে কণ্ঠ দিয়েছেন কে সি দে, পারুল ঘোষ, হরিমতি দুয়া ও সুপ্রভা সরকার। পরে গানটি এই মানুষগুলোর ওপর চিত্রায়িত হয়। কারণ সংগীত ও অভিনয় দুই শিল্পেই দক্ষ কুশীলবরা আগে থেকেই ছিলেন। তবে এবারই প্রথম এই মানুষগুলো শুটিং চলাকালীন ‘লাইভ’ গান গাইলেন না। বরং, তাঁরা প্রি-রেকর্ড করা গানে ঠোঁট নাড়েন। তাঁরাও পদ্ধতিকে অনেক সহজ মনে করলেন। কে ছিলেন এই সংগীত পরিচালক, যিনি এই কর্মযজ্ঞ সম্ভবপর করেছিলেন? আর.সি বড়াল। পুরো নাম রাইচাঁদ বড়াল (Raichand Boral)। ১৯ অক্টোবর তাঁর জন্মদিন। ১৯০৩ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন।
আরও পড়ুন
হেমন্তের গানে রাগ ভুললেন পঙ্কজ মল্লিক, সজল হয়ে উঠল দুটি চোখ
রাইচাঁদ বড়ালকে ‘চলচ্চিত্রের গান ও সংগীতের জনক’ বলা হয়। কালজয়ী সংগীত রচয়িতা অনিল বিশ্বাস এই উপাধি দিয়েছিলেন। গান নিয়ে রাইচাঁদ বড়াল আরো অনেক সফল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। উর্দু গজলকে চলচ্চিত্র সংগীত হিসেবে ব্যবহার তাঁর হাত ধরেই। বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে সাউন্ড এফেক্ট দেওয়ার অনন্য পরিকল্পনার পথিকৃৎ তিনি। এখন যে ধারাবাহিক আবহ সংগীত শোনা যায়, তার ব্যুৎপত্তি রাইচাঁদের ভাবনা।
শোনা যায়, ১৯৩০ সালে আরেক মহান সংগীতজ্ঞ হরিশচন্দ্র বালি কুন্দনলাল সায়গল (কে এল সায়গল)-কে রাইচাঁদ বড়ালের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। প্রখ্যাত গায়িকা কানন দেবীরও উঠে আসা রাইচাঁদের হাত ধরে। ‘মল্লিকা-ই-গজল’ বেগম আখতার কিছুকাল রাইচাঁদের কাছে গানের তালিম নিয়েছিলেন। বড়াল সাহেবের পৃষ্ঠপোষকতায় যাঁরা চলচ্চিত্রের গান ও সংগীত জগতে পা রাখেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম গোলাম মহম্মদ, নওশাদ ও মাস্টার নিসার। মাস্টার নিসার কেবল অভিনেতাই ছিলেন না, গায়কও ছিলেন।
রাইচাঁদ বড়ালের বেড়ে ওঠা সংগীত পরিবেশের মধ্যেই। তাঁর বাবা সাহেব লালচাঁদ বড়াল ধ্রুপদ গানের শিল্পী। নামজাদা গায়কদের আনাগোনা ছিল তাঁদের বাড়িতে। লালচাঁদের তিন পুত্রের সর্বকনিষ্ঠ রাইচাঁদ হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের রামপুর-সাহাসওয়ান ঘরানার গায়ক ওস্তাদ মুস্তাক হুসেন খানের কাছে তালিম নেন। এছাড়াও তিনি বঙ্গ ঘরানার সরোদ বাদক ওস্তাদ হাফিজ আলি খান এবং ফারুখাবাদ ঘরানার তবলা বাদক ওস্তাদ মাসিত খানের কাছে নিয়মিত সংগীত চর্চা করতেন। এভাবেই রাইচাঁদের উঠে আসা, জয় করা চলচ্চিত্র সংগীতের দুনিয়া।
Powered by Froala Editor