আজও জীবিত-জ্ঞানে প্রাচীন মিশরীয় দেবতাদের পুজো করেন কেমেটবাদীরা

‘মুন নাইট’। গত মার্চ মাস থেকে বিশ্বজুড়ে চর্চা চলছে মার্ভেলের কমিক্স চরিত্রটির। কমিক বুকের পরিধি ছাড়িয়ে এখন এই চরিত্র বিদ্যমান ডিজনি প্লাসের পর্দাতেও। যা স্বাভাবিকভাবেই যা আলোড়ন ফেলে দিয়েছে বৈশ্বিক বিনোদন জগতে। আর এই সিরিজের দৌলতেই গুগল ট্রেন্ডের শীর্ষে উঠে এসেছে মিশরীয় মাইথোলজি। মূলত, প্রাচীন মিশরীয় চন্দ্রদেবতা ‘কনশু’ এবং তাঁর মানবাবতারকে কেন্দ্র করেই এই গল্প। শুধু কনশু-ই নয়, প্রাচীন মিশরীয় সমস্ত দেব-দেবীরা মানুষের মতো বিচরণ করছেন এই জগতে— এমনটাই ফুটিয়ে তুলেছে ‘মুন নাইট’। 

এই সিরিজ থেকে চোখ সরাতে না পারলেও, বাস্তবে যে এমনটা অসম্ভব— তা মেনে নেবেন যে-কেউ। তবে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম। তাঁদের বিশ্বাস এখনও জীবিত (Alive) রয়েছেন মিশরীয় দেবতারা (Ancient Egyptian Gods)। এ যেন তুরিনে সংরক্ষিত রহস্যময় মমি ‘আংখেনকনশু’-র সারকোফেগাসে লেখা অমোঘ বাণী। যার অর্থ ‘জীবিত আছেন ভগবান কনশু’। হ্যাঁ, অবাস্তব লাগলেও এমনটাই সত্যি। এই বিশেষ ধর্মমত পরিচিত ‘কেমেটিজম’ বা ‘নেটারিজম’ হিসাবে। আজও রা, তেফনাট, ইসিস, হোরাস, হাথোর, কনশু, আমুন, মাট— প্রায় সমস্ত প্রাচীন মিশরীয় দেবদেবীদেরই পুজো করেন কেমেটবাদীরা (Kemets)।

তবে কি প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা এবং তাদের সংস্কৃতি চিরতরে হারিয়ে যায়নি? বংশানুক্রমিক চলে আসছে এত বছর ধরে? কিন্তু প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা এবং ধর্মমত যে আবিষ্কৃত হয়েছে হালের আমলে। উনিশ শতকের আগে এইসকল দেব-দেবীর অস্তিত্বের কথা ক’জনই বা জানতেন? 

এইসব প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসাটাই স্বাভাবিক। না, কেমেটিজমের গল্পটা তেমন নয়। এই বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্ম হয়েছে বিশ শতকের সত্তর-আশির দশকে। অন্তত মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকদের অভিমত তেমনটাই। কারণ, মিশর নয়, নব্য-পৌত্তলিকতা এবং কেমেটবাদের জন্ম হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বুকেই। উল্লেখ্য, উনিশ শতকেই আবিষ্কৃত হয়েছিল প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা। তবে তার জনপ্রিয়তা বাড়ে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। সাধারণ মানুষকেও আকৃষ্ট করে প্রাচীন মিশরীয় সংস্কৃতির রহস্যাবৃত মায়াজাল। সেই থেকেই কেমেটিজমের জন্ম। এমনটাই অভিমত বিশেষজ্ঞদের। 

আরও পড়ুন
৪৫০০ বছরের প্রাচীন সূর্যমন্দিরের সন্ধান মিশরে


আরও পড়ুন
মিশরীয় সভ্যতারও ২০০০ বছর আগে মমি! কারা বানাতেন সেসব?

১৯৮০-র দশকে কেমেটিজম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় একাধিক কেমেটবাদী গুপ্ত সংগঠন। এখানে আবশ্যিকভাবেই উঠে আসবে তামারা এল সিউদা নামের এক ব্যক্তির নাম। সিউদা মূলত উইকার আচারের অনুসারী ছিলেন। উইকান দীক্ষা নিতে গিয়েই, তিনি অনুভব করেন মিশরীয় সভ্যতার প্রাচীন দেবতাদের সঙ্গে মিল রয়েছে এই আচারের। পরবর্তীতে কেমেটিজমকে স্বীকৃতি দিতে গড়ে তোলেন প্রকাশ্য আন্দোলন। তাঁর হাতেই জন্ম নেয় কেমেটিক অর্থোডক্সি নামের প্রতিষ্ঠান। যা নব্য-পৌত্তলিকা এবং কেমেটিজমের প্রাণকেন্দ্র। 

আরও পড়ুন
ইতিহাসে এই প্রথম অন্তঃসত্ত্বা মমি আবিষ্কার মিশরে

বিফলে যায়নি তাঁর উদ্যোগ। ’৯৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কেমেটবাদীদের পৃথক ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসাবে স্বীকৃতি দেয় খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল, অনুগামীদের পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করেই। ফলে তৎকালীন সময়ে আলাদা করে কেমেটিজমের জনপ্রিয়তার কথা বলে দিতে হয় না। 

এর বছর খানেক পরে ১৯৯৬ সালে মিশর অভিযানে পাড়ি দেন সিউদা। প্রাচীন আচার, রীতিনীতি মেনেই মাথায় তুলে নেন মুকুট। আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন কেমেটবাদীদের ‘ফ্যারাও’ বা ‘নিসুত’ হয়ে ওঠেন তিনি। প্রাচীন মিশরীয় বিশ্বাস অনুসারে, অন্যান্য ফ্যারাওদের মতো তিনিও ছিলেন ঈশ্বরের অবতার। এমনটাই বিশ্বাস ছিল কেমেটদের। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, নিজেকে হোরাসের অবতার হিসাবেই পরিচয় দিতেন সিউদা। 

তবে শুধু আমেরিকাই নয়। পশ্চিমের বিভিন্ন দেশেও গোপন সংগঠন রয়েছে কেমেটদের। হয়তো অস্তিত্ব রয়েছে আলাদা আলাদা ফ্যারাও-ও। তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন দেবতার অবতার। যদিও প্রতিটি অঞ্চলেই রীতিনীতিতে বেশ কিছু তফাৎ রয়েছে। তবে সামগ্রিকভাবে দেখতে গেলে মিশরীয় দেবী ‘মাট’-এর বলে যাওয়া ৪২টি আদেশের কথাই পালিত হয় প্রতিটি ক্ষেত্রেই। 

কিন্তু কেমেটরা কি আদৌ প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা এবং সংস্কৃতির বাহক? নব্বইয়ের দশক থেকে এই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে উঠে এসেছে বার বার। ইতিহাসবিদ মেরিলিন ক্রোগ এবং ব্রুক পিলিফ্যান্টের মতে, কেমেটিক অর্থোডক্সি প্রাচীন মিশরীয় সমাজের প্রতিফলন নয়। বরং, তা আদ্যন্ত আধুনিক একটি ধর্ম। কারণ, মিশরীয় মাইথোলজির সামান্য অংশই প্রকাশ্যে এসেছে এখনও পর্যন্ত। শুধুমাত্র সেটুকুর ওপর ভিত্তি করে তৈরি কেমেটিক ধর্ম। আর বাকিটা আধুনিক কেমেটবাদীদের মনগড়া। ফলে, শুধুমাত্র দেব-দেবীদের নাম দেখেই তাকে প্রাচীন মিশরীয় ধর্মের স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেন তাঁরা। বদলে, কেমেটিজম তাঁদের কাছে একটি আধুনিক ধর্মমত। তবে একথা অস্বীকার করার জায়গা নেই, প্রাচীন মিশরের মতো কেমেটিজমও এক রহস্যময় জগৎ…

Powered by Froala Editor