বইমেলামেশা || পর্ব— ৬
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে টানা বেশ কয়েক বছর রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী শ্রী পীযূষকান্তি সরকার নিয়মিত আসতেন ময়দানে বইমেলায়। তাঁকে নিয়ে, তাঁর গায়কি নিয়ে তখন তুমুল তোলপাড় সারা বাংলায়। বিশ্বভারতী পারলে তাঁকে হাতে কাটে। কিন্তু তিনি ‘থোড়াই কেয়ার’ করেন! মেলায় ঢুকেই কোনো মঞ্চে নয়— একটা কাঠের চেয়ার অথবা একটি কাউন্টার টেবিল জোগাড় করে নিয়ে চড়ে পড়তেন তাতে। আর চশমাপরা, ঝাঁকড়া চুল ও লম্বা দাড়িযুক্ত মুখে গান জুড়তেন উদাত্ত কণ্ঠে, তাঁর একেবারেই নিজস্ব অপেরাটিক স্টাইলে। হৈ হৈ করে শ্রোতা ছুটে আসতেন চারদিক থেকে। গান শেষ হলে তিনি কিন্তু আবার হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যেতেন।
বইমেলায় সবচেয়ে বেশিদিন একত্রে ঘুরেছি বোধহয় কিন্নরদা আর আমি। দু’জনেই প্রত্যেকবার বইমেলায় প্রতিদিন যেতাম। মেলার উদ্বোধনী থেকে সমাপ্তির ঘণ্টাধ্বনি অবধি কভার করে আসতাম। নিঙড়ে নিতে চেষ্টা করতাম সবটুকু নির্যাস। পুস্তকের সই মহাযজ্ঞের যা কিছু ভালো-মন্দ, সারা শরীর ও মন দিয়ে শুষে নিতাম আগামী এক বছরের রসদ হিসাবে।
একজন ব্রহ্মপুর থেকে আসতেন, অন্যজন উত্তরপাড়া। তখন তো মোবাইল ফোন ছিল না। কাজেই বইমেলার মধ্যে আমাদের দেখা করার ব্যাপারটাও বেশ কঠিন ছিল। তবে ব্যবস্থাও করে নিয়েছিলাম আমরা। যে যখনই ঢুকি মেলায় দে’জ ও মিত্র-ঘোষ হয়ে শুরু করতাম। দু’জায়গাতেই দু’জনেরই বই থাকায় কাউন্টারগুলিতে আমরা বলে রাখতাম। এছাড়া আরেকটি কাজও করতাম। দে’জ-এর ডিসপ্লে উইন্ডোর কাচে অ্যাঢেসিভ লাগানো হলুদ প্যাডের পাতা চিটিয়ে দিয়ে লিখে দিতাম ‘কিন্নরদা তিনটে দশে ঢুকেছি। একটা চক্কর দিয়ে সোয়া চারটে নাগাদ আবার আসছি।’
আরও পড়ুন
বইমেলা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন নারায়ণ সান্যাল, পরদিন ভেসে এল মৃত্যুসংবাদ
কিন্নরদা তাই দেখে সময় মিলে গেলে অপেক্ষা করতেন। আর না মিললে নিচে লিখে দিতেন ‘গৈরিক সাড়ে তিনটেয় এসেছিলাম। দুটো কাজ সেরে সাড়ে চারটের মধ্যে অবশ্যই এসে যাব। একটু অপেক্ষা করো।’
আরও পড়ুন
ভস্মীভূত বইমেলাকে মাত্র ৩ দিনে পুনর্জন্ম দিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
তারপর দেখা হলে দু’জনে একসঙ্গে আবার চাঁই-পক-পক!
আরও পড়ুন
যখন টিকিট কেটে ঢুকতে হত বইমেলায়
এরই মধ্যে কোথাও ভগীরথদা (ডঃ ভগীরথ মিশ্র), অমরদা (অমর মিত্র) বা ঝড়েশ্বরদা (ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়)-এর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে এক রাউন্ড চা-সহ আড্ডা। তারপর আবার যে যার দিকে। মেলায় হয়তো বাকিদের সবার সঙ্গে দেখা হত না। কিন্তু উল্লেখ থাক একথা সে গদ্যকারদের এই দলটি তখন বাংলা গদ্যের গতিপথ বদলে দিচ্ছেন নিজেদের লেখনীর জোরে।
আরও পড়ুন
বই কিনতে এগিয়ে এলেন নিমাই ভট্টাচার্য
আর আমি মূলত জীববিজ্ঞান লিখলেও জীবনানন্দ-পাঠক বলে এই দল আমাকে বরাবরই নিজের লোক মনে করেছে।
বইমেলায় খুব অভাব বোধ করতাম আমাদের এডিটর বন্ধুদের— আজকাল-এর শৌনকদা (লাহিড়ী), সাপ্তাহিক বর্তমানে পান্নাদা (পান্নালাল ঘোষ), আনন্দবাজারের প্রমোদদা (বসু)। কাগজের চাকরি হওয়ায় এই সময়টায় ওঁরা একেবারেই ছুটি পেতেন না। আর যাঁকে পেতাম না, তিনি গদ্যকার ঋতুপর্ণ বিশ্বাস। ঋতুদা শ্রীভূমি প্রকাশনীতে কাজ করতেন। তারা প্রত্যেকবার বইমেলায় স্টল করতো। কিন্তু ঋতু কোনোদিন বইমেলায় ডিউটি পেতেন না। কলেজস্ট্রিটের অফিসেই আটকে থাকতেন অজানা কারণে।
Powered by Froala Editor