যখন টিকিট কেটে ঢুকতে হত বইমেলায়

বইমেলামেশা || পর্ব— ৩

মেলা তখনও ভীষণভাবে ময়দানেই। গেস্ট কার্ডে লেখা থাকে : Venue : Maidan on Outram Road. আমরা কিছু কিছু পরিচিতি পাওয়ায় গিল্ড তখন কুরিয়ার সার্ভিসে গেস্ট কার্ড পাঠায় শ্রী ও শ্রীমতীর নাম লিখে। এখানে উল্লেখ থাক যে বইমেলায় তখন টিকিট কেটে ঢুকতে হত। আর ১টি গেস্ট কার্ড থাকলে একজন প্রতিদিন মেলায় যতবার খুশি ঢুকতে বেরতে পারতেন। আমাদের মতো যারা একাধিক কার্ড পেতাম তাদের তো ব্যাপারই ছিল আলাদা। পরিবার বা কখনও বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে গেটে পৌঁছে কার্ডগুলি দেখিয়ে বলতাম, ‘আমাদের একবারে ঢুকিয়ে নেবেন, না আমি বারবার বেরিয়ে সঙ্গে নিয়ে ঢুকব? অঙ্কটা বুঝে নিয়ে ওরা একবারেই ঢুকিয়ে নিত।

পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ডের নিজস্ব মুখপত্র ‘পুস্তকমেলা’-এ তখন নিয়মিত লিখছি। সে ম্যাগাজিনে তখনও আমন্ত্রিত লেখা ব্যতিত ছাপা হয় না। আর সে ম্যাগাজিন বিক্রিরও কোনো ব্যবস্থা নেই। লেখা ছেপে বেরলে লেখক হাতে গরম চেক ও ম্যাগাজিনের কপি পান। উপরি হিসাবে এই সূত্রে বইমেলার opening ceremony-র আমন্ত্রণপত্র ও পেতাম। বাড়ি বসেই। 

বইমেলার ইনোগরাল সেরিমনি তখন সত্যিই অন্যরকম ছিল। এখনকার মতো ‘হরির লুঠ’ বা ‘দরিদ্র নারায়ণ ভোজন’-এর মতো ছিল না। মাননীয় পাঠক এই মুহূর্তে আমায় অত্যন্ত উন্নাসিক এবং উদ্ধত ভাবছেন তো। দয়া করে একটু অন্যভাবে দেখুন ব্যাপারটিকে। ধরুন ইডেনে রঞ্জি ট্রফি চলাকালীন সম্বরণ ব্যানার্জ্জী অথবা ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্স্ বা উত্তরপাড়া সঙ্গীতচক্রের অনুষ্ঠান চলাকালীন পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর সঙ্গে একই খাতির পাচ্ছি লেখকরাও!

আরও পড়ুন
বই কিনতে এগিয়ে এলেন নিমাই ভট্টাচার্য

যাক সেসব কথা। বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হত সর্বসাধারণের জন্য যেদিন বইমেলা খোলা হবে, আর আগের দিন বিকেল সাড়ে চারটেয়। হ্যাঁ! সময়টা বছরের পর বছর একই থেকেছে। ময়দানের মধ্যে মূল (তখন বোধ হয় একমাত্র) যে পিচ রাস্তাটা, সেটি দিয়ে কিছুটা ঢুকলে বাঁহাত বইমেলার ব্যাঙ্কার এসবিআই-এর দোতলা ভবন। আর তার ঠিক উল্টোদিকে মাঠের মধ্যে মঞ্চ ও তার মুখোমুখি দর্শকাসন। পুরো অঞ্চলটি শালবল্লা ও বাঁশ দিয়ে পোক্ত করে ঘিরে দেওয়া। একটি মাত্র প্রবেশপথ। সেখানে অত্যন্ত কড়া নিরাপত্তা-বেষ্টনী। হবে নাই বা কেন? বইমেলার উদ্বোধনে ঐতিহ্য অনুযায়ী এই মঞ্চে গিল্ড কর্তারা ছাড়াও থাকবেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, সে বছরের থিম যে দেশ, সে দেশের একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক (অনেক ক্ষেত্রেই যাঁরা নোবেলজয়ী) এবং আরও বেশ কয়েকজন ভিআইপি।

আরও পড়ুন
প্রথম বইমেলা, প্রথম বই

আর দর্শকাসন! সেখানে একশো থেকে দেড়শো জনের বসার ব্যবস্থা। সাকুল্যে! এবার ভেবে দেখুন গোটা কলকাতা মহানগরী থেকে মাত্র দেড়শো জন আমন্ত্রিত সেখানে।

তো সেই করগুন্তি মানুষজনের মধ্যে আমরা খুব নিকট চারজন মানুষ ছিলাম আমি, কিন্নরদা (সাহিত্যিক কিন্নর রায়), দীপদা (কবি ও ছড়াকার দীপ মুখোপাধ্যায়) আর সমীরদা। শ্রী সমীর গোস্বামী— পূর্ব রেলের চিফ পার্সোনাল ম্যানেজার এবং গিল্ডের ইংরাজি মুখপত্র ‘Bookline’-এর সম্পাদক। 

আমরা তিনজন একসঙ্গে বসলেও, সমীরদা ব্যবস্থাপনায় এত ব্যস্ত থাকতেন যে ওঁর বসার সুযোগই ছিল না। নিজের কাজে অত্যন্ত দক্ষ, ভদ্র, পরিশীলিত, পরোপকারী ও উদারমনা মানুষ তিনি। যত ঘনিষ্ঠ হয়েছি ততই কিন্নরদা ও দীপদার মতো উনিও আমার অগ্রজের জায়গা নিয়েছেন। একবার তো অভিমান ভরে বলেই দিয়েছিলেন, ‘এমন করলে কিন্তু গৈরিক ভাইয়ের লিস্ট থেকে নাম কেটে দেব।’

Powered by Froala Editor