বইমেলামেশা || পর্ব— ২
প্রথম ব্যাচ (১৯৭৬) মাধ্যমিক, গোগ্রাসে ঠোঙাও পড়ে ফেলা সেই ছেলে এরপর জড়িয়ে যায় জীবনের গতানুগতিক প্রবাহ অর্থাৎ গ্র্যাজুয়েশন করা, চাকরি পাওয়া ইত্যাদি দৈনন্দিনে। মধ্যে মধ্যে দু’একবার যে বইমেলায় যাওয়া হয়নি এমনটা নয়। হয়তো বিশেষ কোনো বইয়ের খোঁজ নিয়ে কিনতে, বইয়ের গন্ধ নিতে আর দু’চোখ ভরে বইমেলার মেলাই বই দেখতে।
এরপর আবার পুরোদস্তুর বইমেলায় ফেরা ১৯৯৪ সালে। ততদিনে জীবনসঙ্গীনি এসে গেছেন এবং আমাদের দুই সন্তানও।
এবার লেখক গৈরিক গঙ্গোপাধ্যায় হয়ে, কেবল পাঠক নয়। আমার প্রথম বই— ‘পাখি পোষা ও পোষা পাখি’। বিষয়ের উপর তিন দশকের অভিজ্ঞতা ও পড়াশুনার পর লেখা সেই বই স্ত্রীর গয়না বন্ধক রেখে ছাপিয়েছিলাম। দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল সে বই। প্রথম দু’মাস লাগাতার আনন্দবাজারের বেস্টসেলার লিস্টে প্রথম পাঁচে ছিল। কলেজস্ট্রিটে সে বই বিক্রির দায়িত্ব নিয়েছিলেন শ্রী অনুপ মাহিন্দার। অত্যন্ত ঠোঁটকাটা কিন্তু আদ্যন্ত সৎ মানুষ ছিলেন তিনি। আজ নেই, তবু কোনোদিনই ভোলা যাবে না যে পাঠ্যপুস্তকের প্রকাশকদের সঙ্গে দীর্ঘদিনের (পেশায় শিক্ষক হওয়ায়) সুসম্পর্ক থাকলেও আমার লেখা সেই প্রথম (অ)পাঠ্য বইটি এবং তার লেখককে তিনিই প্রথম পরিচিতি দিয়েছিলেন কলেজস্ট্রিটে।
এমনিতেই প্রত্যেকটি বইমেলা আমাদের জন্য ঘোর নিয়ে আসে। তার উপর সেবছর প্রথম বই। গেটের মুখে দাঁড়িয়ে নিজেই লিফলেট দিচ্ছিলাম নিজের বইয়ের। ছিপছিপে চেহারার এক বয়স্ক ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিলেন। আমি অবাক হয়ে বলি ‘ওরে বাবা! এ কাকে দিলাম!’ উনি হাতের সিগারেটটি নিভিয়ে ফেলে ভিতরে ঢুকতে গিয়েও বেরিয়ে আসেন।
মাথা ভর্তি ঠাসা ও লম্বা চুলগুলি তখনই বোধ হয় সাদা ছিল। বলেন, ‘আপনি চেনেন আমাকে?’
আমি বলি, ‘লেখক নিমাই ভট্টাচার্যকে চিনব না!’
কেন জানি না ‘ধন্যবাদ!’ বলে উনি ঢুকে যান মেলায়। পরে যখন ওঁকে ‘নিমাইদা’ ডাকার সুযোগ হয়েছে তখনও আর জিজ্ঞাসা করা হয়নি সে পাঠক লেখককে চিনতে পারায় উনি ধন্যবাদ বললেন কেন।
মেলা শেষ হতে হতে ডাক এসে যায় ভানুদার। মিত্র ও ঘোষে দেখা করার জন্য। হ্যাঁ, আমি সেই ভাগ্যবানদের একজন যাকে মিত্র ও ঘোষে পৌঁছাতে কোনো কাঠখড় পোড়াতে হয়নি।
দেখা করি গিয়ে ওঁর অফিসে। ভানুদা, শ্রী সবিতেন্দ্রনাথ রায়— ‘পথের পাঁচালি’-রও প্রিন্টার্স পেজ ছাপা হয় যাঁর নাম নিয়ে : মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, ১০, শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, কলকাতা হইতে এসএন রায় কর্তৃক প্রকাশিত।
ওঁকে এক কপি বই দিই আমার। উনি বলেন ‘বেশ দিন। তবে ‘পাখি পোষা ও পোষা পাখি’ এক কপি আমি ইতিমধ্যেই সংগ্রহ করেছি এবং সেটি নেড়েচেড়ে ও পড়েই আমি আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছি।
দু’চার কথার পরেই ভানুদা মিত্র ও ঘোষ থেকে আমার দ্বিতীয় বই করতে চান।
আমি তো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না তখন। ঠাকুমার ঝুলি, আম আঁটির ভেপু, পথে প্রবাসে, প্রথম প্রতিশ্রুতির প্রকাশক আমার বই করবেন।
১৯৯৬-এ প্রকাশ পায় ‘এশিয়ার জীবজন্তু ও পাখি’। আর ততদিনে আমি আশ্রয় পেয়ে গেছি সবিতেন্দ্রনাথ রায় (ভানুদা) নামের এক বটবৃক্ষের স্নেহচ্ছায়ায়।
Powered by Froala Editor