নিরুদ্দেশ

বইমেলা থেকে ফিরে || পর্ব— ৮

'ঝন্টু বিশ্বাস, আপনি ঠাকুরনগর থেকে এসেছেন, মেলায় আপনি আপনার পরিবারের থেকে হারিয়ে গেছেন, আপনি দ্রুত গিল্ড অফিসের সামনে আসুন, আপনার পরিবার আপনার জন্য অপেক্ষা করছে...'

আর আমার? ৩৬ নম্বর টেবিলে... এমন এক বিস্তৃত পরিবার, যাদের রোজের মান-অভিমান আছে। আছে ঝগড়াঝাঁটি, মুখের উপর ফোন কেটে দেওয়া। অথচ মেলা বন্ধ হওয়ার পর কাঁধে হাত রেখে গেট পেরোতে দু'বার ভাবতে লাগে না। এই পরিবারের সঙ্গে রক্তের নয়, অক্ষরের সম্পর্ক আমার, সাদা পাতায় কালো সমস্ত অক্ষর। এ পরিবার আমার একদশকের অর্জন, প্রতিবছর তাদের মুখোমুখি বসা। ভাবি মঙ্গলগ্রহে টেবিল পেলেও হয়তো ব্যাগ হাতে হাসিমুখে পৌঁছে যাবে তারা... আমার বৃহত্তর পরিবার, আমার ভালো থাকার গোপন প্রহরীরা... তিরিশের জীবিত ব্যর্থতার সান্ত্বনা পুরস্কারেরা, যাদের দাঁড়াতে দিতে পারি না বলে স্বপ্ন দেখি স্টল নেওয়ার। যাদের হাসিমুখে জেগে ওঠে শুরুর দিনের উত্তেজনা!

'এই তো মাস্তুল!' কানে আসে, টেবিলের পার্টিশন পেরিয়ে মুখ তুলে দেখি, নিকট আত্মীয়ের মতো পথ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে বন্ধুরা। কারুর চোখে লজ্জা, কেউ সই চাইতে দ্বিধা করছে কবির, এগিয়ে দিই কলম, বিলের পেনে সই করে দেন কবি, সেই পেন ফিরে আসে পুরোনো হাতে, পুরোনো ভূমিকায়। কখনো অন্যের পিঠে কখনও কোলে, কখনও ব্যাগের উপর রেখে কাঁপা কাঁপা হাতের সই, বন্ধুদের ঠাট্টা, ছবি তোলা পেরিয়ে একজন পাঠকের ঘরে পৌঁছে যায় কবির হাতের লেখা, সঙ্গে এমন দু-এক লাইন যা কোনোদিন গ্রন্থিত হবে না। বাকি জীবন বসবাস করবে সেখানে। সময় পেরোবে, প্রজন্ম ঘুরে যাবে, বই যদি থাকে, সইও থেকে যাবে সেখানে। মা অথবা বাবার নামে...

সোশ্যাল মিডিয়া নিঃসন্দেহে দূরত্ব কমিয়েছে পাঠক ও লেখকের। ফ্ল্যাপে লেখকের ছবিও। শব্দের সঙ্গে আলাপ সেরে শিল্পীর যে মুখ আমরা কল্পনা করতাম তা ভাঙার অথবা মিলে যাওয়ার আনন্দ এখন প্রায় নেই বললেই চলে। তবু সই, ব্যাঙ্ক, অফিস বা ডিভোর্স পেপারের বাইরেও এর যে এক অদ্ভুত অস্তিত্ব রয়েছে তা ভুলে যাই কীভাবে! বইমেলার অন্যতম মাধুর্য এই সই!

ঝন্টু বিশ্বাস ৯ নম্বর গেটের কাছে চলে এসেছেন, নিজের পরিবারকে ভুলে, হাতে পাঁচটির মতো ক্যারিব্যাগ বইয়ের। ভিড় বাঁচিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করছেন গিল্ড অফিস কোনদিকে? কীভাবে যাবেন? আমার উত্তরের মধ্যেই চোখে পড়ে যাচ্ছে কোনও একটি বই, তারপর দীর্ঘ কথোপকথন। আমার মনে ভেসে উঠছে তাঁর পরিবারের মুখ। দুশ্চিন্তায় ম্লান হয়ে এসেছে স্ত্রী-এর মুখ, হয়তো জানেনও না উল্টোডাঙা অব্দি বাসে জায়গা পাবেন কী না! ভদ্রলোকের ভ্রুক্ষেপ নেই। বই এমনই অসুখ। বাংলাদেশে ফিরতে হবে যাঁকে, সিন্ডারেলার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন টেবিলে, বই ছাপাখানা থেকে আসছে, রাস্তায়। শুনেছেন এটুকুই। আর দশমিনিট পর তার জুতো হারিয়ে যাবে। অথবা আগামীকাল শেষ হয়ে যাবে বিদেশে থাকার অনুমতি। তবু তো বইটা ভালো! অপেক্ষা তাই তেমন কোনও অপরাধ নয়। 

যুবতী মেঘের মতো বৃষ্টি নামায় এক বান্ধবী, চোখ খুলে দেখি আবদারের সুরে ব্যাগ রেখেছে টেবিলে। বলে চিনে এসেছি দেখ! একটা ফোনও করতে লাগেনি। চা খেতে ডাকি তাকে, প্রবাসের এই সংসারে একটুকরো পাড়া এসে যেন হাজির হয় উঠোনে। ফিরে আসি, বাইরে অব্দি হাত না পৌঁছানো টেবিলের বাইরের দিক গোছাতে থাকি। কানে আসে আনন্দের চিৎকার। এক জনপ্রিয় লেখক বই কিনতে এসেছেন লিটল ম্যাগাজিনে, বান্ধবীর অনুরোধে ছবি তুলে দিই তাঁর সঙ্গে। সঙ্গে বই থাকলে হয়তো এই দৃশ্যে ছবি জায়গা পেত না। বইয়ে সই দিতেই স্বচ্ছন্দ হতেন লেখক। 

আটটা বাজতে চলল, একটু আসছি বলে এগিয়ে যাই বাথরুমের দিকে। ৯ নম্বরের এই বাথরুম বইমেলার সবচেয়ে রঙিন জায়গা। কলকাতা পুলিশের বিশাল বেলুন উপর থেকে লক্ষ রাখে দেওয়ালের গায়ে বাংলা কবিতা লিখে দিয়ে যাচ্ছে কোন তরুণ ছোকরা! ওয়াচ টাওয়ারে বসে ইউনিফর্ম ঠিক করে নেয় তরুণ পুলিশ। রংচঙে জ্যাকেট পরা একদল মহিলা এসে বলেন আজ তেমন নোংরা হয়নি গাছতলা, অপরিচিত এই প্রশংসায় না জেনেই অংশীদার ভাবি নিজেকে! গাছের মতো খুশি হয় ঝন্টু বিশ্বাসের স্ত্রী, বাড়ির জন্য বাসে উঠে পড়ে সপরিবার...


চিত্রগ্রাহক - দেবব্রত কর

Powered by Froala Editor