উপসংহার

বইমেলা থেকে ফিরে || পর্ব— ৬

কাগজে কলমে এক সপ্তাহ পেরোল বইমেলার। আমাদেরও সেই টলোমলো আবেগ কমে আসছে নিশ্চুপে। ব্যস্ততার জীবনে পা গলিয়েছি সেদিন রাতেই, এবার ধীরেসুস্থে মনও স্থিতি পাচ্ছে কাজের জায়গায়। জীবনে ভালো কিছুর দাম তখনই থাকে যখন তা সহজলভ্য হয়ে যায় না, রোজের ওঠাবসার সঙ্গে জড়িয়ে যায় না। যেমন উপহার। বিশেষ সময়ে, বিশেষ মানুষের হাত ধরেই আমাদের কাছে আসে এটি। আজকের পর্ব তাই উপহার নিয়েই।

ভেবে দেখতে গেলে আমি কবে কোথায় অথবা কোন পরিবারে ভূমিষ্ঠ হব, লিটল ম্যাগাজিন করব নাকি গবেষণা করব কোনো রসায়নের গবেষণাগারে এই সবকিছুর সঙ্গে কোনো যোগসূত্রই ছিল না আমার। কোনও এক বর্ষার সন্ধ্যায় আমার জন্মও তাই এক উপহারই বলা যায়। ঠিক যেভাবে প্রতিমুহূর্তে ঘটে যাওয়া ভালো অনেককিছুকেই আমরা নিজেদের দাবি অথবা অর্জন বলে মেনে নিলেও তা আসলে উপহারই। কথা বলতে শেখা ভাষাটিও তাই আমার মা উপহার দিয়েছেন আমাকে। মাতৃভাষা, যে ভাষার চর্চা করব বলে বহু অপ্রাপ্তির সঙ্গে তাঁরা মানিয়ে নিয়েছেন এযাবৎকাল। 

এখানে সেসব কথা থাক, যে ছেলেটি কাল সন্ধ্যায় ফোন করে জিজ্ঞাসা করেছে ‘আকাশদা, লেখাগুলো খুব তাড়ায় লিখছ? আরেকটু বাড়ানো যায় না?’ যে-কোনো খারাপ ফেজে আমি তার ফোনটুকু তুলি না। রিং বেজে যায়। এরপরও হাসিমুখে কথা বলে সে, পাণ্ডুলিপি পড়িয়ে আলাপ করিয়ে দেয় নতুন প্রকাশকের সঙ্গে। বেদাংশু আমার ভাই, ওর বকবক, ওর দুশ্চিন্তা, ওর সিরিয়াসনেস সবের পরেও ওর সঙ্গে আলাপই এক উপহার। দুপুর তিনটে থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কোনো ডায়াবেটিক রুগির পেটে খাবার না পড়লে শেষ দু-ঘণ্টা যে সে ঝিমোয় একথা ওকে কেউই বলে দেয়নি। নিজের দায়ে বুঝে নিয়েছে সে। তাই হাতে করে ক্যাডবেরি এনে দিয়ে গেছে টেবিলের উপর, ‘একটা করে কিউব খেয়ো’। 

আরও পড়ুন
বাক্সবদল

বই যদি পণ্য হয়, বইমেলা তবে বাণিজ্যের এক বিরাট জানলা। এই বাণিজ্যের জানলা দিয়েও কোনো-কোনো হাত মাঝেমধ্যে উঁকি মারে, সে হাতে এগিয়ে আসে উপহার। গত এক দশকের চর্চায় আমরা এটুকুই পেরেছি। মৃদু হেসে পিছনে গিয়ে বদনাম করা নয়, বরং একসঙ্গে ফেরার জন্য বড়ো গাড়ি ভাড়া করে একঘণ্টা অপেক্ষা করেছি আমরা দিনের পর দিন। সেখানে অকথ্য গান চালিয়ে নেচেছি, আবার পরমুহূর্তেই আলোচনা হয়েছে পাতার পোশাক নিয়ে, কবিতা সহায় নিয়ে। আমাদের এই রঙিন বন্ধুত্বের মধ্যে সময়ে সময়ে ভেসে উঠেছে নানা মুখ, তাদের সঙ্গে প্রথম আলাপ মনে পড়ে না, মনে পড়ে না সখ্য কীভাবে তৈরি হয়েছিল, শুধু জানি তারা নিজের মনে করে একবাক্স পরোটা নিয়ে আসে সবার কথা ভেবে। হাজার ব্যস্ততা এড়িয়ে কাকিমার যৌথ রান্নাঘর তাই সুন্দরভাবে মিটিয়ে দেয় জনা পনেরো সন্তানের খিদে। সমীরণ নিজেই একটা সংসার। যে গুটিকতক ছেলেদের দেখে আমি অবাক হয়েছি, যাদের মধ্যে জাগ্রতভাবে তার মায়ের সত্তর শতাংশ বিরাজ করে তারই একজন সমীরণ। শেষরাতে তাই খুলে দেয় পরোটার কৌটো, ক্ষুধার্ত বন্ধুরা এই উপহারে তাকে ভগবান বলে মানি। 

আরও পড়ুন
বই কেন ঝাড়ে

অরিত্র ছাত্র পড়ায়। পারিবারিক কারণেই শিক্ষকদের প্রতি অসম্ভব পক্ষপাত আমার। ওকে দেখলে বোঝা যায়, অসীম ঢেউ ওর মধ্যে, কেবল জানে না কোনদিকে বইলে তা একটি নদীপথ হবে। গুড্ডুর প্রকাশ কম, তবে নিখুঁত দৃষ্টি ওর, টেবিলের ওপাশ থেকেই তাই ধরে ফেলে কখন অফসুইংয়ে যাচ্ছে আমার মেজাজ। মা-র মেজাজ খারাপ হলে যেমন জল ভরে দিই আমরা, কখনো নতুন আবদারের আগে দু-একটা কাজে হাত লাগিয়ে দিই, গুড্ডুও তেমন এসে বসে পাশে, বিলবই হাতে নিয়ে, বিল কাটতে থাকে এরপর। আর মেলার শেষদিনে নিজের ছবির শেষ সেটটি তুলে লিখে দেয় ‘প্রথম প্রয়াসের সাহস মাস্তুলে পেলাম। এই ছবি আকাশকে যে ৯টার ঘণ্টায় মেলা ভাঙতে বসলে কাঁদে, ভালোবাসে আরো একবছর মেলার জন্য অপেক্ষা করতে।’ বন্ধুত্বে ভণিতা নেই আমাদের। আর তাই তন্ময়কে বলতে পারি, ‘আজ আগে গিয়ে টেবিল খোল ভাই, আমি বই তুলে নিয়ে যাচ্ছি।' সেই লাজুক ছেলে আমায় অবাক করে দিয়ে একদিন নিজেই টেবিল সাজায়, আমি যাওয়ার আগে বিক্রিও করে দেয় দু’তিনটি বই। যদিও ওর দেওয়া কোনোকিছুই আমি উপহার বলে বিশ্বাস করতে রাজি নই এখনও। ওকে নিয়ে তাই বেশি শব্দ নয়। 

আরও পড়ুন
হস্তাক্ষর

বইমেলার উপহার নিয়ে লিখলে এ লেখা শেষ হবে না কোথাও। সুমনের দেওয়া ‘অক্ষয় মালবেরি’ এখনও অবসাদে নেমে আসে টেবিলে। নীলাঞ্জনদা অফিস কাটিয়ে নিজের টিফিন বাঁচিয়ে নিয়ে আসে আমাদের জন্য। আসলে এই যে বেঁচে আছি, ভালো আছি, মেলায় যেতে পারছি এসবটুকুই তো উপহার আমাদের। বিন্দুমাত্র অস্বীকার করার জায়গা নেই। এই জীবন, এই নাম, তার ভালোবাসা, সম্পর্ক, একটা ব্রহ্মাণ্ড টিকে আছে উপহারের উপর। সূর্যের আলো পৃথিবীতে আসতে সময় লাগে ৮ মিনিটের মতো। আর কোনও একদিন এই আট মিনিটের টেবিলে বসায় গুড্ডুর মুখ থেকে বেরিয়ে আসে আরেক উপহার, “ভাই সিরিজটার নাম দে ‘বইমেলা থেকে ফিরে’...”

আরও পড়ুন
দূরপাল্লা

Powered by Froala Editor