দূরপাল্লা

বইমেলা থেকে ফিরে || পর্ব— ২

‘গাড়ি নম্বর ১৭৯৫, আজকের মতো হাওড়া যাওয়ার শেষ গাড়ি, যাঁরা হাওড়া যাবেন, এই গাড়িটিতে উঠুন, আর পনেরো মিনিটে গাড়িটি ছেড়ে যাবে।’ 

গলা শুনে মনে হচ্ছে গান করেন ভদ্রমহিলা। আগে কখনও এমন মনে হয়নি আমার, কোনোদিনও না। অথচ এইরকম একটি গলা করুণাময়ী বাসস্ট্যান্ডে বসে ঘোষণা করছে বাসের সময়, তবে কি বইমেলা বলেই বেছে আনা হয়েছে তাঁকে? ভেবে দেখলে রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস, যে ট্রেন ভোরের হাওড়া কেটে পৌঁছে যায় আমার দেশের বাড়ি পুরুলিয়ায় সেই ট্রেনে এমন একটি গলা শুনেছি বারংবার। মানকর থেকে উঠতেন সেই বাউল যুগল। চার লাইন-চার লাইনের কোটা ছিল তাঁদের, একে অপরের দিকে তাকিয়ে গাইতেন আর মুখে ফুটে উঠত এক অদ্ভুত মুগ্ধতা। একই গান, একই শব্দে রোজ গাওয়ার পরও কোনো মুগ্ধতা থাকার কথা কি? বুঝে উঠতে পারিনি কখনও। পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁরা হাসিমুখে গান করছেন, তাল দিচ্ছেন একে অপরকে। এই দৃশ্যে যথাযথ খাপ খেতেন ওই মহিলা গলাটি, কোথা থেকে কে যেন তুলে এনে বসিয়ে দিল তাঁকে বাসস্ট্যান্ডে। রোজ বাড়ি ফেরার সময় তাঁর গলা শুনি আর মনে হয় দূর কোনো ঠিকানার বাস ধরে ফেলি আজ...

সঙ্গে কিছু বই থাকলে টাকাকড়ি লাগে না খুব, খিদে, রাগ, ভয় সবই কেমন এড়িয়ে যাওয়া যায় সাময়িক। আমরা তাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিচ্ছি টেবিলে বসে। সেখানে হুগলি আসছে, হাওড়া আসছে, বাঁকুড়া আসছে, বর্ধমান আসছে, পুরুলিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে গোটা মেলা। অবাক বিস্ময়ে। এই তার প্রথম একক কলকাতা আসা। প্রথম বইয়ের মতো অপ্রস্তুত মুখ নিয়ে এই স্টল ওই স্টল ঘুরে বেড়াচ্ছে ছেলেটি, দাদাদের মুখের দিকে হাঁ করে কী যেন দেখছে। আমি তার সারল্যের পাশে চেয়ার টেনে বসছি, সন্ধে হচ্ছে, বাড়ির কথা মাথায় আসছে খুব, ফেরার পর হিসাব, অন্যান্য কাজ, কাজের অশান্তি ছাপিয়ে সে তাকিয়ে আছে ভিড়ের দিকে। ২৫৬ কিলোমিটার দূরে তার ঘরে মা তখন রান্না বসাচ্ছেন রাতের, বাবা পাড়ায় আড্ডা দিয়ে ফিরবেন ভাবছেন এইবার। আমি তার দিকে প্রশ্ন করতে যাই, কটা বাজবে ফিরতে? পরক্ষণেই মনে পড়ে এ ফেরা সে ফেরা নয়। 

আরও পড়ুন
একান্নবর্তী

দৌড়ে এসে টেবিলে জড়িয়ে ধরল কেউ, ‘আকাশ কেমন আছ?’ হাতদুটো আমার চেনা খুব। কেবল প্রকাশক কবির সম্পর্কের বাইরেও আমরা দুই বন্ধু, যাদের দূরত্বও আছে আর সম্পর্কও। সপ্তাহান্তে কলেজের ক্লাস করিয়ে ছুটে এসেছে ভোরের ট্রেনে। যে দূরত্ব যেতে হিসাব করতে হয় আমাদের সেই দূরত্ব পেরিয়ে এসেছে সপ্তাহে দু-বার। 

আরও পড়ুন
বইমেলায় কাউন্টার টেবিলে চড়ে অপেরা স্টাইলে গান ধরতেন পীযূষকান্তি সরকার

এইসব দূরপাল্লার সম্পর্ক আমাদের জাপটে রাখে গোটা বইমেলা, তারপর শেষদিন কেঁদে চোখ লাল করে ফেলে তারা। আমি তাদের মুখে নিজেকে দেখতে পাই, দেখতে পাই জীবনের চাপে কেমন বড় হয়ে যাচ্ছি, বদলে যাচ্ছি খারাপের দিকে। চক্রধরপুর এক্সপ্রেসে ফিরে যাবে সে, সঙ্গে যাবে আমাদের লিখে দেওয়া বইপত্র। মানকর থেকে সেই বাউল দম্পতি যদি ট্রেনে ওঠে, গান ধরে এই ঈষৎ ঠান্ডার রাতে, একবারও কী মনে পড়বে না তার করুণাময়ীর সেই গলা? নিচু হয়ে দেখে নেবে না, টেবিলের নীচে কিছু রয়ে গেল কিনা শেষবার?

আরও পড়ুন
বইমেলা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন নারায়ণ সান্যাল, পরদিন ভেসে এল মৃত্যুসংবাদ

চিত্রগ্রাহক - অরিত্র দত্ত

আরও পড়ুন
ভস্মীভূত বইমেলাকে মাত্র ৩ দিনে পুনর্জন্ম দিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য

Powered by Froala Editor