বইমেলা থেকে ফিরে || পর্ব— ১
প্যাভেলিয়ানের আলো নিভে যাচ্ছে। এখনও ব্যাগ গুছিয়ে উঠতে পারেনি কেউ কেউ। টেবিলের নিচে খুঁজে নিচ্ছে জরুরি কিছু রয়ে গেল কিনা… দু’একটা চিঠি, কয়েকটি বিনামূল্যে বিলি করা কাগজ, দড়ি, ফেলে যাওয়া বিল আর ব্যস্ততার সময়ে খাওয়া চায়ের ভাঁড় যা বাইরে অব্দি গিয়ে ফেলে আসা হয়নি। এভাবেই বাড়িবদল হয়। এক ঠিকানা থেকে আরেক ঠিকানায় যাওয়ার সময় এভাবেই আমরা ফেলে আসি যা কিছুতে মায়া আছে অথচ প্রয়োজন নেই আর। তারপর কোনও এক অচেনা ঝাড়ুদার সেসব সরিয়ে নিয়ে যায় সযত্নে। আমাদের সঙ্গে সেইসব মুহূর্তের আর কোনো যোগাযোগ থাকে না।
কলকাতা বইমেলা এবছরের মতো খাতায়-কলমে শেষ। কিন্তু তার ল্যাজের ঝাপটা সামলাতে আরও দু’সপ্তাহ… এই মুহূর্তে কেউ অশান্তি সামলাচ্ছে বাড়ির, কেউ বা ডাক্তারখানায় ছুটছে। চোদ্দো দিনের এই ধকল সামলে খানিক শান্ত হয়ে আছে বইপাড়াও। দু-একটা দোকান খুলেছে, সেখানেও এসে পৌঁছায়নি মেলা-ফেরতা বই। প্রেসের লোকজন এখন সুখনিদ্রায়। বাঁধাইখানার বিহারী ছেলেটি ছুটি নিয়েছে বাড়ি যাবে বলে। অপাঠ্য বাংলা অক্ষরের পিছনে হারিয়ে গেছে তার পরিবারের মুখগুলো। এই রিক্সাওলা থেকে বাদাম বিক্রেতা, বাঁধাই শিল্পী থেকে ডাক্তারবাবু, নিজেদের অজান্তেই বইমেলার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছেন।
উত্তেজিত সম্পাদক থেকে অলস লেখক পর্যন্ত একটি লম্বা রেখা টানলে তার মাঝখানে কোনো এক তরঙ্গমুখে ঝুলে থাকবে আমাদের এই মেলা। বিতর্ক বা ঝামেলার শেষে ফোন বেজে ওঠে, তাতে কিছু শোনা যায় না। সম্পাদক টেবিল ছেড়ে ছোটে গেটের দিকে, বই এসেছে। প্রেসের যে মানুষটি না জেনেই চর্চা করে যাচ্ছেন বাংলা সাহিত্যের, বইমেলার গেটে থতমত মুখে দাঁড়িয়ে তাঁর যেন ঈশ্বরদর্শন। একজন লাজুক যুবতী আর তাঁকে মুগ্ধ করা কবির মাঝে যে লম্বা টেবিল দু-ফুটের, যার এপাশ থেকে ওপাশ হাত পৌঁছায় না, সেই টেবিলে সাজানো বই কেবল অক্ষরশিল্পী বা প্রকাশক অথবা পাঠকের নয়। তাতে জড়িয়ে আছে গোটা দশেক পরিবারের পেট। আমরা যাদের ছাপাখানার ভূত বলে চিনি। যারা চাইলে এক তরুণ প্রকাশক চব্বিশ ঘণ্টায় ছেপে আনতে পারে চারফর্মার একটি বোর্ড বাঁধাই বই, আর সেই বই দেখে ভিডিও কলে কেঁদে ফেলেন লেখক। এসব কথা জানে না ছাপাখানার মানুষগুলি, তারা কেবল জানে সম্পর্ক রাখতে। জানে প্রিন্টার্স পেজে একলাইন নাম আর ঠিকানা ছাড়া কোনো স্বীকৃতিই জুটবে না এই জগৎ থেকে। কেউ গল্প লিখবে না, কোনো সাক্ষাৎকার না। বরং বই নিয়ে ঢোকা যাবে না বলে আটকে দেওয়া হবে মেলার গেটে। সেখানে থতমত দাঁড়িয়ে তারা এই সার্কাস দেখবে। দেখবে বৈঠকখানা আর দপ্তরের বাইরে একটা বিশাল জগৎ একজায়গায় হয়েছে এই ছোট্ট মাঠে, যেন এই দেশ এক প্রকাশনী আর বইমেলা তার পুস্তক তালিকা।
আরও পড়ুন
বইমেলায় কাউন্টার টেবিলে চড়ে অপেরা স্টাইলে গান ধরতেন পীযূষকান্তি সরকার
সময়ের এক নিজস্ব ছন্দ আছে, বহুসময়েই আমরা খারাপটা বুঝতে পেরে তাকে এড়িয়ে এগিয়ে যাই আরও বেশি খারাপের দিকে। আর সেখান থেকে আমাদের বার করে আনে কিছু অদ্ভুত মানুষ। মুহূর্তে তাঁরা মহামানব হয়ে ওঠে। স্ত্রীয়ের ওষুধ কেনার টাকায় টান পড়লেও তরুণ প্রকাশকের কাছে চাইতে পারেন না নিজের পাওনা টাকা। মানুষ এমনই হয়ে যায় অসুখে। বই তেমনই এক অসুখ। ‘বাচ্চা ছেলেটা চেষ্টা করছে কিছু করার’ ভেবে অভিভাবক হয়ে ওঠা প্রেসের এই দাদা দিদি, কাকা-জ্যাঠাদের কথা আমরা বেমালুম ভুলে যাই প্রয়োজন ফুরোলে, অথচ শেষ মুহূর্তের আবদারে তাঁরা কীভাবে যেন বুঝে যান আমার কাছে একটি বইয়ের গুরুত্ব, দেরি করে জমা দেওয়া অথবা অন্যায় আবদারে প্রশ্রয় দিয়েই ছেপে নিয়ে আসেন অন্তত কিছু কপি। বারোটা বলে, পঁচিশটা কপি পাঠিয়ে দেন মেলার মাঠে। এই সম্পর্ক কি কেবলই অর্থনৈতিক লাভ? ভেবে দেখলে, আমিও কি তাই করতাম ওঁর জায়গায় থাকলে? সম্ভবত না…
আরও পড়ুন
বইমেলা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন নারায়ণ সান্যাল, পরদিন ভেসে এল মৃত্যুসংবাদ
বইমেলার আলো নিভছে। দমকলের পোশাকে থাকা সুদর্শন যুবকেরা বাড়ির গল্প করছে এ-ওর সঙ্গে। ময়লার লরি শেষবারের মতো টহল দিয়ে যাচ্ছে বইমেলা। আমাদের স্মৃতি থেকে মুছে যাচ্ছে পেনের কালি, ফেলে যাওয়া বিল, মুছে যাচ্ছে বন্ধুর চোখ, অভিমান, রাগ কিম্বা ছাড়ের দরাদরি। মুছে যাচ্ছে অপরিচিত একান্নবর্তীর ছায়া, যাঁরা অজান্তেই আমাদের অভিভাবক হয়ে পাশে পাশে হেঁটেছে এই পুনর্জন্মের বইমেলায়…
আরও পড়ুন
ভস্মীভূত বইমেলাকে মাত্র ৩ দিনে পুনর্জন্ম দিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
Powered by Froala Editor