১৯৫০ সালে কর্মসূত্রে ইংল্যান্ড রওয়ানা দিলেন সত্যজিৎ। তাঁর মাথায় তখন সিনেমা তৈরির পোকা আর কয়েক বছর আগে পড়া 'পথের পাঁচালী' উপন্যাসের চালচিত্র। জাহাজে যাত্রাকালীন দিনলিপির পাতায় একটু একটু করে গড়ে উঠল 'অপুর পাঁচালী'। যে নোট থেকে পরবর্তীতে জন্ম নিয়েছিল মোট তিনটি সিনেমা। শুরুটা অবশ্যই 'পথের পাঁচালী' দিয়ে। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দেশের দর্শকরা সেদিন দেখল, দেশ মানে কাঁটাতারে ঘেরা একটা মানচিত্র নয়। দেশ মানে গ্রামের মানুষ, ক্ষেতখামার, পুকুর, নারকেল মালায় ছড়ানো জীবন। যার চেহারাটা উপন্যাস লেখার সময় থেকে সিনেমা তৈরি পর্যন্ত ২০ বছরে তেমন একটা বদলায়নি।
আজও খুব একটা বদলেছে কি? হয়তো জীবনের মূল সুর কোথাও বদলাবার নয়। আর তাই এই সিনেমা বাঙালির নস্টালজিয়া। সত্যজিতের সিনেমা মায়া বাঙালিকে আজও নিয়ে যায় নিশ্চিন্দিপুরের পথে পথে। কিন্তু সেই সাদাকালো দৃশ্যগুলো কি রঙিন হয়ে ওঠে না দর্শকদের কল্পনায়? ৬৫ বছর আগের সেই প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতাকে যদি অতিক্রম করতে পারে আজকের দর্শকরা, তবে কেমন লাগবে ভেবে দেখেছেন কি? সম্প্রতি সেই কাজটাই করে দেখালেন বাংলাদেশের একজন ভিডিও এডিটর।
বাংলাদেশের এডিটর রাকিব রানার ভিডিওতে আমরা দেখতে পাব 'পথের পাঁচালী' সিনেমার কিছু দৃশ্য। তবে সেগুলো পরিচিত সাদা-কালো দৃশ্য নয়। তার মধ্যে আছে রঙিন ছোঁয়া। আর সেই কোলাজ ভিডিওর সঙ্গে আছে মূল সিনেমায় ব্যবহৃত রবিশঙ্করের যান্ত্রিক অনুষঙ্গ। ইএসআরজিএএন, ডিওল্ডিফাই প্রভৃতি আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তির সাহায্যে দৃশ্যপটের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন রাকিব। গত ফেব্রুয়ারি মাসে এক রাশিয়ান ইউটিউবার প্রথম যুগের ফরাসি চলচ্চিত্র 'দ্য অ্যারাইভাল অফ আ ট্রেন'এর দৃশ্যপট রঙিন করে তোলেন। এখান থেকেই অনুপ্রেরণা পান রাকিব। আর এই কাজের জন্য তিনি বেছে নিলেন 'পথের পাঁচালী'কেই। এটা তো শুধু বাংলা বা ভারতবর্ষের নয়, সারা পৃথিবীর সিনেমার ইতিহাসের এই সম্পদ। তাছাড়া, এই মাসেই ছিল পরিচালকের ১০০তম জন্মদিন। রাকিবের এই কাজ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্যও বটে।
১৯৫৫ সালে মুক্তি পাওয়ার পরেই সাড়া ফেলে দিয়েছিল 'পথের পাঁচালী', আর সেইসঙ্গে পরিচালক নিজেও। দুই বিভাগে জাতীয় পুরস্কার তো ছিলই, তাছাড়াও কান ও সান-ফ্রান্সিসকো চলচ্চিত্র উৎসব পুরস্কার এবং বোডিল সহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছিল 'পথের পাঁচালী'। আর সুব্রত মিত্রের ক্যামেরার সেই অনন্য দৃশ্যগুলো যখন নতুন চেহারা নিয়ে হাজির হয়, তখন নতুন করে উস্কানি পায় আমাদের নস্টালজিয়া। তাই ভিডিও ইউটিউবে আপলোড করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে নেটিজেনদের হাত দিয়ে। অবশ্য এক্ষেত্রে নেটিজেনদের মধ্যে দুধরনের বক্তব্য লক্ষ্য করা গিয়েছে। রাকিবের কাজ দেখে স্বভাবতই মুগ্ধ একদল। কিন্তু অপর পক্ষের বক্তব্য, সাদা-কালো দৃশ্যগুলোই যেন অনেক বেশি প্রাণবন্ত। অনেকক্ষেত্রে সূক্ষ্ম কিছু বিষয় ভুলেও গিয়েছেন রাকিব। যা নজর এড়ায়নি সত্যজিৎ-প্রেমীদের।
রাকিবের তৈরি ভিডিও শেয়ার করে অভিনেত্রী জয়া আহসান লিখেছেন, 'পথের পাঁচালী রঙিন হলে যেমন লাগত'। সেই পোস্টে ভিডিও নির্মাতার উদ্যোগের প্রশংসা করেও পরিচালক শুভ্রজিৎ মিত্র মত প্রকাশ করেছেন, অনুভূতির গভীরতায় ঘাটতি চোখে পড়েছে। তাঁর মতে সাদা-কালো ক্যামেরার কথা মাথায় রেখেই প্রতিটি দৃশ্যের পরিকল্পনা করেছিলেন পরিচালক। রঙিন ক্যামেরা হলে দৃশ্য অন্যরকম হত। তবে সাদা-কালোতেই অনেক স্পষ্ট ফুটে ওঠে গ্রাম্যজীবনের চালচিত্র। তাই অপুর জীবনের শেষ অঙ্ক নিয়ে নির্মীয়মান 'অভিযাত্রিক' সিনেমায় সাদা-কালো দৃশ্যায়ন ঘটাতে চলেছেন পরিচালক। তবে যেকোনো নতুন উদ্যোগের জন্য প্রশংসা এবং সমালোচনা দুই বরাদ্দ থাকে। কিন্তু এই উদ্যোগের মধ্যে বাঙালির যে শ্বাশ্বত নস্টালজিয়ার অনুভূতিটি আছে, তাকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়।
Powered by Froala Editor