ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস— মানুষের জীবনকালকে মূলত এই চারখণ্ডে ভাগ করে দিয়েছিল প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি। আর চতুরাশ্রমের প্রথার শুরু অধ্যায় ব্রহ্মচর্যের শুরুটা হত উপনয়নের মাধ্যমে। কালের আবহে চতুরাশ্রম হারিয়ে গেলেও, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে আজও টিমটিম করে জ্বলে রয়েছে উপনয়নের প্রথা। উপনয়নের সময় সংশ্লিষ্ট বালককে তিন দিন থাকতে হয় অন্ধকার ঘরে। এমনই রীতি জড়িয়ে এই শাস্ত্রানুষ্ঠানের সঙ্গে। কিন্তু সেই আঁধারযাপনের সময়সীমাই যদি দীর্ঘায়িত করে দেওয়া হয় কয়েক বছর?
এক কথায় তা অসম্ভব। বিষয়টা কল্পনাতেও আনা বেশ কঠিন যে কারোর পক্ষে। তবে এমনই বিচিত্র রেওয়াজ রয়েছে কলোম্বিয়ার (Colombia) সিয়েরা নেভাদা দে সান্তা মার্তা পাহাড়ের কোগি উপজাতি (Kogi Tribe) সমাজে। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে ৯ বছর বয়স পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে অন্ধকারেই বড়ো হতে হয় এই উপজাতির শিশুদের। তবে সকলকে নয়। ‘মামা’ বা পুরোহিত সম্প্রদায়ের শিশুদেরই যেতে হয় এই কঠিনতম পরীক্ষার মধ্য দিয়ে। কিন্তু তার কারণ কী?
এই প্রশ্নের উত্তরের আগে, কোগিদের সম্পর্কে আরও বেশ কিছু তথ্য জেনে রাখার প্রয়োজন আছে বৈকি। সিয়েরা নেভাদার এই ‘সভ্যতা’-র বয়স ঠিক কত, তা আজও অজানা। আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগের কথা। ১৪৯৯ সালে কলোম্বিয়ায় প্রথম পা পড়ে ইউরোপীয়দের। ষোড়শ শতকের গড়ে ওঠে স্প্যানিশ বসতি, উপনিবেশ। ভূমিপুত্রদের সঙ্গে ইউরোপীয়দের সংঘাত চলেছিল নিরন্তর। তবে কলোম্বিয়ার নানান প্রাচীন উপজাতি গোষ্ঠী ক্রমশ সভ্যতার দিকে ভিড়লেও, স্প্যানিশ আধিপত্য বিস্তারের পর থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন জীবনযাপনে অভ্যস্ত কোগিরা।
কোগিদের বিশ্বাস, পৃথিবী নিজেই একটি জীবন্ত প্রাণী। কোগিদের ভাষায় পৃথিবী হল ‘আলুনা’ বা ‘পরম মা’। প্রকৃতি এবং মানব সভ্যতা তাঁর সন্তান। আর এই আলুনার হৃদয় হল গোনাউইন্ডুয়া পর্বত। আমাদের কাছে যা পরিচিত পিকো ক্রিস্টোবাল শৃঙ্গ বলে। এই পর্বতেই বসবাস কোগিদের। কোগি পুরাণ অনুযায়ী, তাঁরাই এই হৃদয়ের রক্ষাকর্তা। কোগিদের শিশুরা ভূমিষ্ঠ হয় এই পর্বতেরই জনমানবহীন গুহাতে। সেখানে বিন্দুমাত্র প্রবেশ করে না দিনের আলো।
আরও পড়ুন
একে অপরের ‘রক্তপান’ করে ভ্রাতৃত্বের শপথ! এমনই রীতি নানা দেশে
এক-দু’বছর নয়, দীর্ঘ ন’বছর এভাবেই তাদের কাটাতে হয় অন্ধকারের মধ্যে। বিছিন্ন থাকতে হয় বাবা-মায়ের থেকেও। বদলে, তাদের লালনপালন করে পুরোহিত তথা মামা সম্প্রদায়ের মানুষেরা। কেবলমাত্র স্তনদুগ্ধ খাওয়ানোর অনুমতি মেলে মায়েদের। ধীরে ধীরে বয়স বাড়লে বহির্প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিত করতে তাদের গুহার বাইরে নিয়ে আসেন মামারা। তবে তখনও কালো কাপড়ে চোখ বাঁধা থাকে তাদের। ন’বছরের এই অন্ধকারযাপন আধ্যাত্মিক বা অলৌকিক ক্ষমতা প্রদান করে বলেই বিশ্বাস কোগিদের। মধ্যবর্তী সময়ে কোগি শিশুদের শেখানো হয় ঝিঁঝিঁর সুর, পাখিদের ভাষা, টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ কিংবা প্রকৃতির সঙ্গে কথপোকথনের গোপন বিদ্যা। আমাদের কাছে কোগিদের এই ‘পাঠ্যক্রম’ অনেকটা রূপকথার মতোই।
আরও পড়ুন
দেবতাজ্ঞানে ফিলিপ-পুজো, ইয়াহোনানেন জনজাতির মধ্যে আজও প্রচলিত যে রীতি
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় অন্য জায়াগায়। গোটা বিশ্বের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নভাবে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে প্রকাশ্যে এল তাঁদের এই যাপনচিত্র? সেটা নব্বইয়ের দশক। নিজেদের প্রথা ভেঙেই ‘সভ্য’ জগতের কাছে ধরা দিয়েছিল কোগিরা। গোটা বিশ্বকে সতর্ক করতে। মানব সভ্যতার প্রসার, শিল্পোন্নয়ন, বৃক্ষচ্ছেদন ক্রমশ প্রাণ মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে আলুনাকে— এই সাবধানবাণী দিতেই তাঁদের আত্মপ্রকাশ। সেসময় একাধিক সংবাদমাধ্যমেই উঠে এসেছিল তাঁদের অলৌকিক জীবনযাপনের গল্প। বিবিসি’র সৌজন্যে মুক্তি পেয়েছিল বিশেষ তথ্যচিত্রও। এর পর ২০১৩ সালে আরও একবার মানবজাতিকে সতর্ক করতে, বিশ্বের সংবাদমাধ্যমগুলির দ্বারস্থ হয়েছিল কোগিরা। কিন্তু একথা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই মানব সভ্যতার বিস্তারে ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে পৃথিবীর আয়ু। বিশ্ব উষ্ণায়ন কিংবা সমুদ্রতল বৃদ্ধির মতো সমস্যায় জর্জরিত নীলগ্রহ। সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন থেকেও কোগিরা সেসব কীভাবে টের পেল— তা আজও থেকে গেছে রহস্য হয়েই…
আরও পড়ুন
কুস্তিতে শীর্ষ সাফল্য দুই দিদির, পারিবারিক 'প্রতিযোগিতা'য় পিছিয়েই আত্মহনন রীতিকার?
Powered by Froala Editor