ভারতে এই প্রথম কবিতা উপস্থাপনা ইকারো ভালদেরামার, নেপথ্যে কলকাতা পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্স

মানুষের কণ্ঠস্বরের নেপথ্যে রয়েছে ভোকাল কর্ড। তবে যেকোনো ভাষাতেই শব্দ উচ্চারণের ক্ষেত্রে অনিবার্যভাবে প্রয়োজন পড়ে ওষ্ঠ, দন্ত, জিহ্বা, নাসিকা, তালু— এই পাঁচ অঙ্গের। কিন্তু অর্থবহ শব্দ উচ্চারণ ছাড়াই কেবলমাত্র কণ্ঠের মৌলিক স্বরের মাধ্যমে কি অভব্যক্তি ফুটিয়ে তোলা যায়? ভাবছেন এ কেমন ধাঁধাঁ? হ্যাঁ, অবাক লাগারই কথা। তবে প্রাচীন যুগ থেকে এমনই এক প্রথা মিশে রয়েছে সাইবেরিয়া ও মঙ্গোলিয়ার সংস্কৃতিতে। আর এই বিশেষ শিল্প মাধ্যমটির নাম ‘থ্রোট সিঙ্গিং’ (Throat Singing)।

এবার কলকাতা মহানগরী স্বাদ পেতে চলেছে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প মাধ্যমটির। সম্ভবত গোটা ভারতেও এই প্রথমবার আয়োজিত হতে চলেছে থ্রোট সিঙ্গিং-এর অনুষ্ঠান। নেপথ্যে, কলকাতা পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্স। ‘ভাষা সংসদ’ এবং ‘অ্যান্টোনিম’-এর যৌথ উদ্যোগে আগামী ১০ তারিখ থেকে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হতে চলেছে অনুবাদ কবিতা এবং বিশ্ব সাহিত্যকে কেন্দ্র করে এই আন্তর্জাতিক কবিতা সম্মেলন। আর সেই মঞ্চেই ঐতিহ্যবাহী থ্রোট সিঙ্গিং-এর মোড়কে নিজের কবিতা উপস্থাপন করবেন কলোম্বিয়ান কবি, দার্শনিক, গায়ক, সম্পাদক এবং প্রযোজক ইকারো ভালদেরামা (Ikaro Valderrama)। বলতে গেলে এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হতে চলেছে ভারত। 

ইকারোর জন্ম ও বেড়ে ওঠা কলোম্বিয়ায় হলেও, পরবর্তীতে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির স্বাদ পেতে ঘুরে বেড়িয়েছেন গোটা পৃথিবীর মানচিত্রে। সেভাবেই তাঁর হাজির হয়ে পড়া সাইবেরিয়ায়। কখন যেন সেখানকার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি মিশে গেছে তাঁর কণ্ঠে, কবিতা উপস্থাপনায়। তাঁর কথায়, “আমি থ্রোট সিঙ্গিং-কে বেছে নিইনি, বরং থ্রোট সিঙ্গিংই আমাকে বেছে নিয়েছে।” থ্রোট সিঙ্গিং ছাড়াও কোটোডামা শিল্পেরও অন্যতম সাধক ইকারো। ‘কোটোডামা’-র আক্ষরিক অর্থ ‘আত্মার ভাষা’।

ইকারোর সঙ্গে কথা বলতে বলতে বার বার উঠে আসছিল সেই আত্মা এবং আত্মীয়তার যোগের কথাই। কবিতার এত ফর্ম থাকতেও থ্রোট সিঙ্গিং-কে বেছে নেওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করতে ইকারো জানালেন, “আমার মনে হয়, কবিরা প্রকৃতির জানা-অজানা নানান রহস্যের যন্ত্রমাত্র। মহাবিশ্বের জন্মলগ্ন থেকে নৈঃশব্দ্যের বিবর্তন শুরু হয়েছে। নিস্তব্ধতা থেকে ক্রমে জন্ম নিয়েছে আওয়াজ, সিলেবল, অর্থবহ শব্দ, বাক্য। আমাদের পূর্বপুরুষরা কিন্তু গানের মাধ্যমেই কবিতা উপস্থাপন করতেন। ইউরোপীয়ই হোক কিংবা ভারতীয়, যেকোনো মহাকাব্য দেখলেই বোঝা যাবে সেই কথা। সেই আধ্যাত্মিকতার কাছে পৌঁছাতেই থ্রোট সিঙ্গিং-এর জগতে ধরা দেওয়া।”  কোথাও গিয়ে যেন মানব সভ্যতার শিকড়ের অনুসন্ধানই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সাইবেরিয়ান যন্ত্রের পাশাপাশি তিনি তাঁর কবিতা উপস্থাপনায় ব্যবহার করেন ইলেকট্রিক গিটার ও নানান আধুনিক যন্ত্রও। পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে পূর্বপুরুষদের যোগসূত্রের মাধ্যম হিসাবেই তিনি দেখেন বিষয়টিকে।

আরও পড়ুন
অনুবাদ কবিতার মহোৎসব, ঐতিহাসিক ‘পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্স’-এর সাক্ষী হতে চলেছে কলকাতা

আগামী জুন মাসের ৮ তারিখ কলকাতায় পা রাখছেন ইকারো। তারপর কলকাতার দৃষ্টিহীন শিল্পীদের নিয়ে দু-দিনের ওয়ার্কশপে মেতে উঠবেন তিনি। কলকাতার শিল্পীদের ‘কোটোডামা’ শিল্পের ‘দীক্ষা’ দেবেন কিংবদন্তি কলোম্বিয়ান কবি ইকারো ভালদেরামা। কলকাতা পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্সের মঞ্চে ১১ জুন উপস্থাপিত হবে দৃষ্টিহীন শিল্পীদের নিয়ে তাঁর সেই অনুষ্ঠান। 

আরও পড়ুন
১৯ মে-র বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন নিয়ে স্বতন্ত্র পত্রিকা, প্রকাশ কলকাতা থেকেই

তবে এই প্রথম নয়, ভারতের মাটিতে ইকারো পা রেখেছেন আগেই। কলকাতার সঙ্গেও রয়েছে তাঁর আত্মীয়তার যোগ। হাসি মুখেই তিনি জানালেন, ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের পাঠ নিতে তিনি হাজির হয়েছিলেন দিল্লিতে। সেটা ২০১৪ সাল। মাস খানেক দিল্লিতে কাটিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। “দিল্লিতে আমি যাঁর কাছে গান শিখেছি, সেই মহুয়া মুখার্জি-ও কিন্তু কলকাতার মানুষ। তাছাড়া কলোম্বিয়াতেও আমি ভারতীয় সঙ্গীতের পাঠ নিয়েছি আনন্দিতা বসুর কাছে। তিনিও বাঙালি। তাছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলার আধ্যাত্মিকতা, কালীমন্দির ও অন্যান্য পীঠস্থান তো রয়েছেই। ফলে, কলকাতার ব্যাপারে আমার আগ্রহ চিরকালীন”, উত্তেজনায় ফুটছিলেন ইকারো। 

আরও পড়ুন
কবিপক্ষের কলকাতা ও একটি সঙ্গীতসন্ধ্যা

কলকাতা একাধিক সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র। তাকে পূর্বভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী বললেও ভুল হয় না এতটুকু। এই সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র ও কলোম্বিয়ার মধ্যে সাংস্কৃতিক সেতু তৈরি করতে ইকারো কতটা উৎসাহী, তা বোঝা যাচ্ছিল তাঁর কণ্ঠস্বর থেকেই। বেশ উৎসাহী হয়েই তিনি জানালেন, নিজের কবিতাতেও ভারতীয় সংস্কৃতির অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। ‘কালী’, ‘সরস্বতী’ এবং ‘দেবী’ নামে তিনি লিখেছেন তিনটি কবিতা। সেগুলি জায়গা পেয়েছে তাঁর গ্রন্থে। “কলকাতায় কবিতা উপস্থাপনের থেকেও কলকাতার কবিতা শোনা, সেখানকার মানুষ ও তাঁদের শিল্প-সংস্কৃতির স্বাদ পাওয়ার নেশাই আমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে হাজির করছে কলকাতায়”, জানালেন ইকারো। সবমিলিয়ে ১০-১২ জুন— এক ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক মুহূর্তের সাক্ষী হতে চলেছে কলকাতা। তা যেকোনো বাঙালি কবিতাপ্রেমী এবং সঙ্গীতানুরাগীর কাছেই ‘অমূল্য রতন’…

Powered by Froala Editor