২০১১ সালের ১২ নভেম্বর। দিনটা ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে আজীবন। শান্তি চুক্তির জন্য গেরিলা যোদ্ধাদের সঙ্গে সেদিন সরাসরি আলোচনায় বসেছিলেন কলোম্বিয়ার রাষ্ট্রপতি হুয়ান ম্যানুয়েল স্ট্যান্টোস। কলোম্বিয়ার ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী দিন ছিল সেটাই। জায়গায় জায়গায় আক্রান্ত হয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ। গৃহযুদ্ধের সেই পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন তিনিও। চিরকালের মতো বদলে গিয়েছিল তাঁর জীবন। হুয়ান হোসে ফ্লোরিয়ান (Juan Jose Florian)। সেদিনের সেই যুদ্ধবিধ্বস্ত যুবকই, প্রতিবন্ধকতাকে হারিয়ে আজ গোটা বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন শান্তির বার্তা। আবার কখনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় প্রতিনিধিত্ব করছেন নিজের দেশের।
হ্যাঁ, বর্তমানে কলোম্বিয়ার শীর্ষস্থানীয় প্যারা-সাইক্লিস্ট হুয়ান। অল্পের জন্য টোকিও অলিম্পিকের সুযোগ হাতছাড়া হলেও, তাঁর ঝুলিতে রয়েছে একাধিক আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পদক। তবে এই লড়াই-এর পথ খুব একটা সহজ ছিল না। বা, বলা ভালো এর সূত্রপাত হয়েছিল একেবারে কিশোর বয়স থেকে।
তখন কতই বা আর বয়স তাঁর। বড়ো জোর দশ কি এগারো বছর। কলোম্বিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে অবিরত। ফ্লোরিয়ানের দাদা তখন কাজ করতেন জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীতে। আর সেই সূত্রেই তাঁকে বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায় এফআরএসি গেরিলা যোদ্ধারা। পরিবারের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে বছরের পর বছর বাধ্য করা হয় তাঁদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে। আরেকটু বয়স বাড়ার পর নজর তাঁদের এড়িয়েই বাড়িতে পালিয়ে আসেন তিনি। তারপর তিনিও যোগ দেন দেশের সেনাবাহিনীতে।
প্রায় দশ বছর কলোম্বিয়ান সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন ফ্লোরিয়ান। সেই সুবাদে তাঁর প্রাক্তন সহযোদ্ধারাই যে প্রতিশোধ নেবে, তা আর কে জানত? দুর্ঘটনা ঘটে যায় শান্তি চুক্তির দিনই। বাড়ির সদর দরজায় পরিকল্পনা করেই গেরিলা যোদ্ধারা রেখে গিয়েছিল একটি পার্সেল। সরল মনেই তা স্পর্শ করেছিলেন ফ্লোরিয়ান। তারপরই ঘটে যায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ। দুটো হাত এবং বাঁ পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় শরীর থেকে। শুধু প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন
প্যারালিম্পিকে প্রথম বাঙালি পদকজয়ী, চেনেন মনোজ সরকারকে?
সেই যন্ত্রণা, ক্ষত, বীভৎসতা পিছু ছাড়েনি দীর্ঘদিন। শারীরিকভাবে খানিক সুস্থ হয়ে উঠলেও মানসিকভাবে ফ্লোরিয়ান বিপর্যস্ত ছিলেন দীর্ঘদিন। শেষ পর্যন্ত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় কলোম্বিয়ার সরকার। সেনাবাহিনীর তৎপরতাতেই শুরু হয় কাউন্সিলিং। প্রস্থেটিক্সের হাত-পায়ের ব্যবস্থাও করে দেয় সেনাবাহিনীই।
আরও পড়ুন
প্যারালিম্পিকে সর্বকালের সেরা ফলাফল, পদক পেলেন কারা?
এক কথায় বলতে গেলে, তাঁর নবজন্ম হয় তারপরেই। মনের জেদেই ফের নিজের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে মরিয়া হয়ে ওঠেন ফ্লোরিয়ান। সাঁতার কাটা দিয়েই শুরু করেন নতুন জীবন। ফিরেছেন ফুটবল মাঠেও। শেষ পর্যন্ত আগামী পথের পাথেয় হিসাবে সাইক্লিংকেই বেছে নেন তিনি। বিগত পাঁচ বছরে জাতীয় স্তরে নিজের জায়গা তো পাকাপাকি করে নিয়েছেনই, সেইসঙ্গে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাতেও রীতিমতো ছাপ ফেলেছেন ফ্লোরিয়ান। টোকিও প্যারালিম্পিক হাত ছাড়া হলেও থামতে নারাজ ৩৮ বছর বয়সী প্যারা-সাইক্লিস্ট। পরবর্তী প্যারালিম্পিকই এখন পাখির চোখ তাঁর। তবে এখানেই থেমে নেই তাঁর কর্মকাণ্ড, লড়াই। সাইক্লিং-এর মাধ্যমেই গোটা বিশ্বকে তিনি বার্তা দিচ্ছেন শান্তির, পরিবেশরক্ষার। কলোম্বিয়ার অস্থিতিকর পরিস্থিতিতে তরুণ প্রজন্মের কাছে আদর্শ এখন ফ্লোরিয়ানই। তাঁর এই লড়াই একদিন ছ’দশক ধরে চলে আসা গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটাবে, সে ব্যাপারে যথেষ্ট আশাবাদী কলোম্বিয়ার প্যারাসাইক্লিস্ট…
আরও পড়ুন
৫৩ বছর বয়সে সোনা জিতে চমক ডাচ প্যারালিম্পিয়ানের
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
বোমা-বিস্ফোরণে পা হারিয়েও অশ্বারোহণ, প্যারালিম্পিকে রূপকথা লিখছেন বেয়াত্রিচে