দৈর্ঘ্যে ৩ ফুট, প্রস্থে ২০ ইঞ্চি। ওজন ১৬৫ পাউন্ড অর্থাৎ প্রায় ৭৫ কিলোগ্রাম। গাধার চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা ৩১০ পাতার প্রকাণ্ড একটি গ্রন্থ। যে গ্রন্থ কারোর একার পক্ষে বয়ে নিয়ে যাওয়াই অসম্ভব। কিন্তু যদি বলা হয়, এই গোটা বইটাই লেখা হয়েছিল এক রাতের মধ্যে এবং একজন লেখকই এই গোটা বইটার স্রষ্টা? স্বাভাবিকভাবেই এ-কথা বিশ্বাস হবে না কারোরই। তবে আকার-আয়তন এবং ওজনের দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম পাণ্ডুলিপির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এমনই কিংবদন্তি।
কোডেক্স জাইগাস (Codex Gigas)। যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘দৈত্যাকার গ্রন্থ’। হ্যাঁ, আকার আয়তনের জন্যই এহেন নাম। তবে এই গ্রন্থের মধ্যে লিপিবদ্ধ বিষয়বস্তুর সঙ্গেও দত্যিদানোর সম্পর্ক জড়িয়ে রয়েছে লতায়পাতায়। কথিত রয়েছে, এই গ্রন্থ লিখেছেন স্বয়ং শয়তান, লুসিফার (Lucifer)। আর সেই কারণে এই গ্রন্থ স্থানীয়দের কাছে পরিচিত ছিল ‘শয়তানের বাইবেল’ বা ‘ডেভিল’স বাইবেল’ (Devil's Bible) নামে।
শুরু থেকেই বলা যাক ঘটনাটা। সেটা ত্রয়োদশ শতকের শেষ বা চতুর্দশ শতকের শুরুর দিক। এই গ্রন্থ রচিত হয়েছিল চেক প্রজাতন্ত্রের বোহেমিয়ার একটি খ্রিস্টান মঠে। নেপথ্যে এক খ্রিস্টান সন্ন্যাসী হেরমান দা রিক্লুজ। অবশ্য তিনিই যে এই গ্রন্থের রচয়িতা তা বিশ শতকের আগে পর্যন্ত জানা ছিল না। পরবর্তীতে গবেষণায় উঠে আসে তাঁর নাম। কিন্তু খ্রিস্টান সন্ন্যাসী হঠাৎ এহেন ‘অভিশপ্ত’ বই রচনা করতে গেলেন কেন?
কিংবদন্তি অনুযায়ী, কোনো এক গুরুতর অপরাধের জন্য হেরমানকে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি দেন তৎকালীন বোহেমিয়ার সম্রাট। পরিত্রাণ পেতে প্রাণভিক্ষা করেন তিনি রাজার কাছে। জানান, বিশ্বের সমস্ত গুপ্তবিদ্যা এবং জ্ঞান দুই মলাটের মধ্যে সংকলিত করে দেবেন তিনি। তাতে খানিকটা হলেও চিড়ে ভেজে। রাজি হয়ে যান রাজা। তবে শর্ত দেন মাত্র ১ রাতের মধ্যেই তাঁকে শেষ করতে হবে এই গ্রন্থ। নাহলে গিলোটিনে গর্দান যাবে তাঁর।
এই গ্রন্থ একরাতের মধ্যে রচনা সম্ভব না, তা বেশ ভালো মতোই বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। তবে কি প্রাণ দিতে হবে তাঁকে? সমাধান খুঁজতে, ঈশ্বরকে ছেড়ে শয়তানের কাছে দ্বারস্থ হন তিনি। কারণ, ঈশ্বর যে কোনোভাবেই রাজি হবেন না গুপ্ত ও নিষিদ্ধ বিদ্যা লিপিবদ্ধ করার জন্য। হেরমান নরকের রাজপুত্র লুসিফারের কাছে প্রার্থনা করেন, একরাতের মধ্যে এই গ্রন্থ সম্পূর্ণ করে দেওয়ার জন্য। তবে শয়তানই বা কেন 'বিনামূল্য'-এ গ্রন্থ রচনা করতে যাবেন? বাধ্য হয়েই তাই নিজের আত্মাকে বাজি রাখতে হল খ্রিস্ট ধর্মযাজককে। শয়তানের সঙ্গে চুক্তি হল, আজীবন দাস হয়ে থাকবেন তিনি। তাঁর দেহ ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে পারবেন লুসিফার। আর তারপরই পূর্ণতা পায় 'কোডেক্স জাইগাস'। আশ্চর্য এই গ্রন্থ অবাক করেছিল খোদ বোহেমিয়া-রাজকেও। শেষ পর্যন্ত প্রাণ বাঁচে হেরমানের। কথিত আছে, এই গ্রন্থ লেখা শুরু হওয়ার পর নাকি জ্ঞান হারান স্বয়ং হারমান।
এ তো গেল কিংবদন্তি। কিন্তু এই গল্প আদৌ মিথ নাকি সত্যি? বার বার ফিরে ফিরে এসেছে এই প্রশ্ন। গবেষণাও হয়েছে বিস্তর। চেক প্রজাতন্ত্রের একদল গবেষকের মতে, প্রতিদিন ৬ ঘণ্টা সময় দিলেও, ৩১০ পাতার এই প্রকাণ্ড গ্রন্থটি লিখতে একজনের কমপক্ষে ৩০ বছর লাগা উচিত। ফলে, একরাতে সম্পূর্ণ গ্রন্থরচনার সম্ভাবনাটা মাঠেই মারা যায় এখানে। তবে মজার বিষয় হল, স্টকহোমের বশ কিছু গ্রাফোলজিস্ট অর্থাৎ হস্তলিপি-বিশারদ এবং একাধিক মার্কিন গবেষকদের বিশ্লেষণ বলছে, আদ্যন্ত একজন ব্যক্তিরই হাতে লেখা এই গ্রন্থ। আর বয়স? অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন, কার্বন ডেটিং-এর মাধ্যমে এই গ্রন্থের প্রথম ও শেষ অধ্যায়ের বয়স নির্ণয় করলেই তো জানা যেতে আরে এই গ্রন্থের নির্দিষ্ট রচনাকাল। হ্যাঁ, সেই চেষ্টা যে করা হয়নি, তা নয়। তবে ফলাফল বলছে, গোটা গ্রন্থের ব্যবহৃত কাগজই তৈরি হয়েছিল একইসময়ে।
সবমিলিয়ে ৭০০ বছর পেরিয়েও আজ রহস্যের মাফলার জড়িয়ে রেখেছে 'কোডেক্স জাইগাস'। কিন্তু কী লেখা আছে এই গ্রন্থে?
গ্রন্থের শুরুতেই রয়েছে ল্যাটিন বাইবেলের পূর্ণ সংস্করণ। ওল্ড টেস্টামেন্ট ছাড়াও লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল সম্পূর্ণ নিউ টেস্টামেন্ট। রয়েছে ফ্লেভিয়কস জোসেফাসের লেখা ইহুদি যুদ্ধ ও পুরাতত্ত্বের অনুলিপি, সেন্ট ইসডরের বিশ্বকোষ। তাছাড়াও একাধিক ব্ল্যাক ম্যাজিক ও গুপ্তবিদ্যার প্রকাণ্ড সমাহার এবং অসংখ্য ছবি। যার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল, ২১০ পাতায় আঁকা খোদ লুসিফারের ছবি। 'নরকের রাজপুত্র'-কে এই ছবিতে দেখানো হয়ে নগ্নগাত্র অবস্থায়। এই ছবির ঠিক বামপাশেই রয়েছে জনশূন্য জেরুসালেমের ছবি। যা ফুটিয়ে তোলে পরিচিত বাইবেলের সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। কথিত আছে, এই ছবিই নাকি 'লেখক' লুসিফারের স্বাক্ষর।
প্রাথমিকভাবে এই গ্রন্থ চেক প্রজাতন্ত্রের বোহেমিয়াতে থাকলেও, পরবর্তী তা হাত ঘুরে পৌঁছায় হাঙ্গেরিতে। ১৫৯৪ সালে গ্রন্থটির অধিকার আদায় করেন হাঙ্গেরির রাজা দ্বিতীয় রুডলফ। ১৬৪৯ সালে হাঙ্গেরি-সুইডিস যুদ্ধের সময় এই গ্রন্থ লুঠ করেন সুইডেনের সেনারা। গ্রন্থটির জায়গা হয় সুইডেনের রাজ-গ্রন্থাগারে। ১৬৯৭ সালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয় এই গ্রন্থাগার। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, ৯৫ শতাংশ বই পুড়ে গেলেও বেঁচে যায় 'কোডেক্স জাইগাস'। কোনোভাবে বিস্ফোরণের কারণে জানলা ভেঙে বাইরে চলে আসে সেটি। যদিও এই প্রকাণ্ড, ভারি গ্রন্থ কীভাবে বাইরে এল আপনা থেকেই, তা নিয়ে যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা আজও খুঁজে পাননি গবেষকরা। যদিও মূল গ্রন্থটি রেহাই পেলেও, গ্রন্থের শেষের ১২টি পাতা ছিঁড়ে নিয়ে যায় কোনো অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি। লোককথা অনুযায়ী, খোদ লুসিফারই দায়ী এই কর্মকাণ্ডের জন্য।
সে যাই হোক, এর প্রায় সাড়ে তিনশো বছর পর এই গ্রন্থে ফিরে আসে চেক প্রজাতন্ত্রে। তার প্রাচীন জন্মভূমিতে। সেটা ২০০৭ সাল। দীর্ঘ ১ বছর তা প্রদর্শিত হয় প্রাগের লাইব্রেরিতে। ২০০৮ সালে তারপর আবার তা ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সুইডেনের স্টকহোম শহরে। সেখানকার মিউজিয়ামেই বর্তমানে সংরক্ষিত আছে এই গ্রন্থ। অবশ্য জনসাধারণ এই গ্রন্থ ছুঁয়ে দেখার সুযোগ না পেলেও, এই মিউজিয়ামে গিয়ে পড়তে পারেন 'অভিশপ্ত' এই গ্রন্থের ডিজিটাল সংস্করণ। তাই বা কম কী?
Powered by Froala Editor