হাপিত্যেশ করা ছাড়া উপায়ই বা কী বলুন তো? শার্লক হোমসের নামে ক্লাব। তাও খোদ কলকাতায়। ‘হোমসিয়ানা’ নামকরণের মুন্সিয়ানাটিও চোখে পড়ার মতো। কে দিলেন নাম? না, সুকুমার সেন। শুনলেই কেমন বোবা হয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। যদিও পৃথিবীর নানা দেশেই হোমসের নামে ক্লাব আছে। কলকাতার ক্লাবটি সেখানে যেন সাতরঙা পালক। কে না ছিলেন সেই ক্লাবের সঙ্গে জড়িয়ে। জ্ঞানীগুণী মানুষের ভিড়ে ঠাসা এক আড্ডাখানা। আর শুধু কি শার্লক হোমস? বাংলা গোয়েন্দা গল্প নিয়েও চলত চুলচেরা বিচার। নতুন গল্পের জন্মও হত আড্ডা দিতে গিয়ে। শার্লক হোমসকে শিরোনামে রেখে বাংলা সাহিত্যের তুফানছোটা ক্লাব। সবই ছিল, আজ আর নেই।
"অতি ধূর্ত্ত ঠগী, তাই
নাম রাম-সিয়ান।
তাই তো তাদের গোপন ভাষার
রামসিয়ানা নাম।
মানবজ্ঞানের কৌতূহলী
শার্লক হোমসের চেলা
হোমসিয়ানা নাম দিয়ে তাই
বন্ধু পাঁচের খেলা।।"
১৯৮৫ সালের ১২ই ডিসেম্বরে সুকুমার সেনের লেখা। নাম ছিল- 'আর্য্যা হোমসিয়ানা' । ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে ‘জয়ন্ত-মানিক, ব্যোমকেশ বক্সী, ঘনাদা, ফেলুদা প্রেমীদের একটি ক্লাবের জন্ম হল জব চার্নকের এই শহরে…’ - আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এই খবর। শনিবার, একে বারবেলা, তায় নষ্টচন্দ্র তিথি। সেসব মিলিয়ে ওই শনিবারেই আত্মপ্রকাশ গোয়েন্দাপ্রেমীদের এই ক্লাবের। নষ্টচন্দ্র তিথি নাকি চোরেদের দিন। তাই সেদিনখানাই আদর্শ। ২৭ শে জুলাইএর প্রথম সভা বসল সুকুমার সেনের বাড়িতে। রবীন্দ্রনাথের 'কঙ্কাল' গল্পটি গোয়েন্দাগল্প কিনা, তা নিয়ে তুমুল তর্কে প্রথম দিনেই জমে উঠল আসর। তর্কের একদিকে সুকুমার সেন, অন্যদিকে প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত। সেই তর্কের জের চলল পরের দিনের সভাতেও। সেটি বসেছিল নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বাড়িতে। সন্তোষকুমার ঘোষ, সমরেশ বসু, সত্যেন্দ্রনাথ ঘোষাল, শোভন বসু, সিদ্ধার্থ ঘোষ - সমবেত উপস্থিতিতে উজ্জ্বল সেই আসর। শনিবারে শনিবারে ফুল ধরার মতোই বসত হোমসিয়ানার অপূর্ব আড্ডা। প্রেমেন মিত্র, গজেন্দ্রকুমার মিত্র, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, গৌরকিশোর ঘোষ, আনন্দ বাগচীরাও জটলা করতেন সুযোগ বুঝে। এই আড্ডার টানে কখনো আবার আসতেন সত্যিকারের গোয়েন্দাও। যেমন কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি কমিশনার সুবিমল দাশগুপ্ত।
ফুল ফুটিয়েছিল এই জমায়েত। অনেক লেখকই নিজেদের লেখা গল্প এই আসরে পাঠ করেছেন। সুকুমার সেন, সত্যেন্দ্রনাথ ঘোষাল। বারোয়ারি উপন্যাসের জন্ম হয়েছিল এখানেই। পাঁচজন লেখক মিলে লিখেছিলেন 'পাঞ্চজন্য' উপন্যাস। আনন্দ বাগচী, রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, সুকুমার সেন ও সুভদ্রকুমার সেন। শালর্ক হোমসের শতবর্ষ উপলক্ষে বইটি প্রকাশিতও হয়। তাতে সুকুমার সেন লেখেন- ‘রবীন্দ্র-জন্মের অব্দ বিশা শ'য় পাঁচে/বইখানি বার হল হোমসিয়ানা-ছাঁচে’।
আড্ডা যখন, তাতে রসনারও তৃপ্তি একান্ত আবশ্যক। একদিকে রহস্যঘন আলো-আঁধারিতে যখন গোয়েন্দাগল্প গায়ে কাঁটা তুলছে, ঠিক তার পাশেপাশেই সাপ্লাই হচ্ছে - চপ কাটলেট লম্বা বেগুনভাজা লেডিকেনি কচুরি। সুকুমার সেন এর নাম দিচ্ছেন পঞ্চভূত। সংস্কৃতে বিবরণও লিখছেন তার-
‘পঞ্চতত্ত্বাত্নকং খাদ্যং পঞ্চভূত প্রকল্পিতম/দীয়তে ভূতদর্শিভ্যঃ কথকেভ্যস তথৈব চ।।/ভূতং তু কৃষ্ণবর্ণনং যৎ ত্বিষাকৃষ্ণা ত প্রেতিনী/কুরসুরঃ পলটরগায়িষ্ট আরব্যঃ পুটফস্থবৎ।।/অত্যদ্ভুতং তু য়ুরোপে ব্ল্যাকম্যাসেতি সংজ্ঞতম।।/চীনীয়-চা-পানেন তৃপ্তিং যান্তু মণীষিণ’
বেশ হইহই করেই টানা ছ-বছর চলেছিল ক্লাবটি। ১৯৯০ সালে ক্লাবের সভাপতি তথা পাকাপাকি সদস্য প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত মারা যান। হোমসিয়ানার অ্যাটেন্ডেন্স খাতার ২৩/১১/৯০ তারিখের সভার পাতাটি সাদা। আর তারপর একে একে দেউটি নেভে। সমরেশ বসু, সুকুমার সেনের মৃত্যু হয়। হোমসিয়ানাও তার যাত্রা থামায়।
কলকাতা শহরে তখন আরো কিছু সাহিত্য-আড্ডা বসত। তবে হোমসিয়ানা তার বিষয়-আঙ্গিক - সবদিক থেকেই ছিল খুব নতুন। আজকাল সাহিত্য পড়ার লোক কমেছে। আড্ডা দেওয়ার অবসরই বা কোথায়? বিভিন্ন কফিশপে আজকাল বইপত্র সাজানো থাকে, দেখি। তাতে সাহিত্য আড্ডা তেমন হয় কি? সেমিনার হয়, কবিতা পাঠের আসরও বসে। তবে এমন ফলদায়ী আড্ডা যদি আরো একবার বসত…