বর্তমানে গোটা বিশ্বই চিন্তিত জলবায়ু পরিবর্তন (Climate Change) নিয়ে। অথচ, পশ্চিমবঙ্গে তার কতটা প্রভাব পড়েছে কিংবা পড়তে চলেছে— তা নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য সেভাবে সামনে আসেনি এতদিন। এবার ‘জিরো কার্বন অ্যানালিটিক্স’-খ্যাত আন্তর্জাতিক জলবায়ু গবেষণা সংস্থার রিপোর্ট রীতিমতো চিন্তার ভাঁজ ফেলল গবেষকদের কপালে। বিগত চার দশকেই ২ লক্ষ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে পশ্চিমবাংলার সর্ববৃহৎ বায়োডায়ভার্সিটি হটস্পট সুন্দরবন (Sundarbans)!
হ্যাঁ, ২ লক্ষ কোটি! যেখানে ২০২১ সালে গোটা ভারতের জিডিপি বা আয় ছিল ৩.১৭ লক্ষ কোটি টাকা। ১৯৮৪ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে চলা একাধিক গবেষণার তথ্য ও নথির ওপর ভিত্তি করেই চালানো হয়েছে এই গবেষণা। বিচার্য বিষয়ের মধ্যে ছিল এই সময়ের মধ্যে ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক পরিবর্তন এবং দুর্যোগগুলিও। সেইসঙ্গে সুন্দরবনের জল-হাওয়া-মাটিতে কী ধরনের বদল এসেছে, সেটাও বিশ্লেষণ করেছিলেন গবেষকরা।
সুন্দরবনের এই ব্যাপক বিপর্যয়ের কারণ হিসাবে প্রথমেই উঠে এসেছে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ। গবেষণা অনুযায়ী, বিগত ২১ বছরে সুন্দরবনে হানা দিয়েছে ১৩টি অতিঘূর্ণি। যার মধ্যে রয়েছে আয়লা, সিডার ইয়াস কিংবা আমফানের নাম। ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণেই এইধরনের নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ বাড়ছে বলেই স্পষ্ট ইঙ্গিত পাচ্ছেন গবেষকরা। ১৮৮১ সাল থেকে ২০০১— এই দীর্ঘ ১২০ বছরের ইতিহাসে ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ বেড়েছিল মাত্র ২৬ শতাংশ। সেখানে দাঁড়িয়ে বিগত ২০ বছরে এই সংখ্যা ছুঁয়েছে ২০ শতাংশ। আগামী ২০৪০ থেকে ২০৬০ সালের মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা বেড়ে দাঁড়াবে ৫০ শতাংশ, ভবিষ্যদ্বাণী গবেষকদের।
ঘূর্ণিঝড়ের কারণে একদিকে যেমন বিপন্ন হয়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ, তেমনই বিপর্যয়ের শিকার বন্যপ্রাণীরাও। রিপোর্ট অনুযায়ী, ঘুর্ণিঝড়ের প্রকোপে গত ২৫ বছরে ভিটেছাড়া হয়েছেন ১৫ লক্ষ মানুষ। তাছাড়া সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের যে ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ করে তুলতে প্রয়োজন প্রায় ৩২ কোটি টাকার প্রকল্পের। দু’দশকেই ধ্বংস হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের অধীনে থাকা ১১০ বর্গ কিলোমিটার ম্যানগ্রোভ অরণ্য। ম্যানগ্রোভ অরণ্যের ক্ষয়ই পরোক্ষভাবে বিপন্ন করে তুলছে বহু ক্ষুদ্রতর প্রজাতিকে। তাছাড়াও প্রতি ঘূর্ণিঝড়ের সময় সমুদ্রের নোনা জল চাষের জমি ও মাছ চাষের পুকুরে ঢুকে বাড়িয়েছে লবণতা। পরিসংখ্যান বলছে বিগত চার দশকে ক্ষেত্রবিশেষে ৬-১৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে লবণের পরিমাণ। যার কারণে শুধু চাষের ক্ষেত্রেই ক্ষতি হয়েছে দেড় লক্ষ কোটির।
বলতে গেলে, সুন্দরবনের সংরক্ষিত অরণ্যের এই ক্ষত সারিয়ে তুলতে যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে, তা এক-কথায় অপ্রতুল। আরও আশঙ্কার বিষয় হল, আগামীদিনে এই সংকট ক্রমাগত বাড়বে আরও। কাজেই সুন্দরবন রক্ষার জন্য বিশেষ পর্যালোচনা ও প্রকল্পের প্রয়োজন জরুরি ভিত্তিতে…
Powered by Froala Editor