কফিনবন্দি মৃতদেহ ঝুলিয়ে রাখাই রীতি এইসব দেশে!

অরণ্যের মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশালায়তন পাথরের ঢিবি। উচ্চতা কমপক্ষে ১০০-১২০ ফুট। কখনও তার থেকেও বেশি। পাথুরে দেওয়াল বেয়ে এই পাহাড়ের মাথায় চড়া যে-সাধারণ মানুষের পক্ষে কার্যত অসম্ভব। অথচ, এই পাহাড়ের গায়েই কারা যেন গর্ত করে তৈরি করেছে কাঠের মাচা। সেখানে ঝুলিয়ে রেখেছে মিটার খানেক দৈর্ঘ্যের কিছু কাঠের বাক্স। চিনের দক্ষিণাঞ্চলে গেলেই দেখা মিলবে এহেন আশ্চর্য এক দৃশ্যের। না, কোনো মণিমুক্ত কিংবা গুপ্তধন লুকিয়ে রাখা নেই এইসব বাক্সে। বরং, সেখানে শায়িত রয়েছে মৃত মানবদেহ। 

আসলে ধর্ম, সংস্কৃতি এবং ক্ষেত্র বিশেষে বদলে বদলে যায় মানুষের সৎকার পদ্ধতি। মৃত্যুর পর দেহ দাহ করেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। মাটির নিচে কফিনবন্দি করে দেহ সমাধিস্থ করেন ইসলাম ও খ্রিস্ট ধর্মের মানুষজন। জোরোয়াস্ট্রিয়ানিজম বা পার্সি ধর্মমতে আবার মানুষের দেহ মৃত্যুর পর ফিরিয়ে দেওয়া হয় প্রকৃতির কাছে। কাক-শকুন কিংবা কুকুর-শেয়ালে ঠুকরে খায় মৃতদেহ। আবার আজও মমির প্রচলন আছে পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে। ঠিক সেভাবেই দক্ষিণ চিনে মানুষদের কোনো উঁচু পাহাড়ে সমাধিস্থ করা হয় ঝুলন্ত অবস্থায়। শুধু চিনই নয়, ফিলিপিনস, ইন্দোনেশিয়া-সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একাধিক দেশেই প্রচলিত রয়েছে এমন আশ্চর্য প্রথা। যা পরিচিত ‘ক্লিফ বারিয়াল’ (Cliff Burial) নামে। 

মূলত দক্ষিণ চিনের বো এবং গুইয়ে উপজাতির মানুষজন এই বিশেষ প্রথার অনুসারী। অন্যদিকে ফিলিপিনস, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অন্যান্য দেশে এই রীতির ধারক ও বাহক ইগোরেট নামের উপজাতির মানুষেরা। কিন্তু কেন এরকম দুর্গম অঞ্চলে প্রিয়জনদের মৃতদেহ ঝুলিয়ে রেখে আসেন তাঁরা? 

তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে আজও। প্রচলিত রয়েছে একাধিক জনমত। তবে প্রতিটি জনগোষ্ঠীর লোককথার সারার্থই হল স্বর্গারোহন। গুইয়ে ও ইগোরেট উপজাতির মানুষদের বিশ্বাস, মাটির থেকে বেশ খানিকটা উচ্চতায় কফিনবন্দি মৃতদেহ ঝুলিয়ে রাখা হলে, দ্রুত মুক্তি পায় মানুষের আত্মা। এমনকি সমাধিস্থ হওয়ার পরই পূর্বপুরুষদের নিকটে পৌঁছে যান তাঁদের প্রিয়জন। মনে করা হয়, যত বেশি উচ্চতায় ঝুলিয়ে রাখা হয় প্রিয়জনদের কফিন, তত দ্রুত ও সহজ পথেই স্বর্গারোহন করেন তাঁরা। 

এ-তো গেল লোককথা। কিন্তু আদতে কি কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি লুকিয়ে রয়েছে আশ্চর্য এই রীতির পিছনে? কখনই বা প্রচলন হয়েছিল এই রীতিটির? নয় নয় করে হলেও, এই প্রথার বয়স প্রায় ৩ হাজার বছর। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে শুরু হয়েছিল মানবদেহ সমাধিস্থ করার এই পদ্ধতি। যে-সকল গোষ্ঠীর মধ্যে এই রীতি প্রচলিত, দেখতে গেলে তারা সকলেই সংখ্যালঘু। গবেষকদের একাংশের অনুমান, প্রাচীনকাল থেকেই বৈষম্যের শিকার হয়ে এসেছে এই জনগোষ্ঠীগুলি। তার অন্যতম উদাহরণ হল, দক্ষিণ চিনে মিং রাজবংশের শাসনের সময় তিয়েন উপজাতির সম্পূর্ণ অবলুপ্তি। উল্লেখ্য, এই উপজাতির মানুষরাও অভ্যস্ত ছিলেন ঝুলন্ত অবস্থায় দেহ সমাধিস্থ করার রীতিতে। সবমিলিয়ে বলতে গেলে, বৈষম্যের কারণেই গভীর অরণ্যে স্বল্প অঞ্চলের মধ্যেই গড়ে উঠেছিল এইসব জনগোষ্ঠীর ছোটো ছোটো জনপদ। তাই জায়গার অভাব মেটাতেই কৃষিজমিতে দেহ সমাধিস্থ করার বদলে ঝুলন্ত কফিনের ব্যবহার শুরু করেন তাঁরা। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে হওয়ায়, সাধারণ কফিনের তুলনায় ঝুলন্ত কফিনগুলি বেশি নিরাপদ বলেই মনে করতেন তৎকালীন মানুষ। 

অবশ্য এই সবটাই তত্ত্ব। এখনও পর্যন্ত কোনো সুস্পষ্ট নথি পাওয়া যায়নি কোথাও-ই। খাতায়-কলমে প্রমাণও মেলেনি কোনো। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, এক মিটার বাক্সের মধ্যে কীভাবে অনায়াসে জায়গা করে নেয় আস্ত একটি মানব শরীর? আসলে এখানেও লুকিয়ে রয়েছে আশ্চর্য এক প্রথা। আর পাঁচটা সাধারণ কফিনের মতো, এই কফিনগুলিতে লম্বাভাবে শোয়ানো হয় না মৃতদেহ। বরং, ভ্রূণ অবস্থায় মাতৃগর্ভে মানুষ যেভাবে কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকে, সেভাবেই মৃতদেহকে শোয়ানো হয় এই কফিনে। আর সেই প্রক্রিয়াও বেশ বিচিত্র।

মৃত্যুর পর মানুষের দেহকে কাঠের চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা হয় শক্তভাবে। তাতে প্রাথমিকভাবে ভাঁজ হয়ে যায় দেহের আকার। এরপর বিভিন্ন ভেষজ ঔষধ মাখিয়ে তা ঢেকে দেওয়া হয় কম্বলে। অনেকটা মিশরের মমির মতোই। সব শেষে শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানের পর ভাঁজ হওয়া এই দেহকে বাক্সে স্থানান্তরিত করা হয়। কখনও আবার জায়গা সংকুলান না হলেও, ভেঙে দেওয়া হয় মৃতদেহের হাড়। সেইসঙ্গে বাক্সের ফাঁকা স্থান ভরে দেওয়া হয় বিভিন্ন লতাপাতা দিয়ে। 

আশ্চর্যের বিষয় হল, চিনের দক্ষিণাঞ্চল এবং ফিলিপিনস থেকে উদ্ধার হওয়া বেশ কিছু প্রাচীন ঝুলন্ত কফিনের ওজন প্রায় এক টনের এক চতুর্থাংশ। অর্থাৎ, প্রায় আড়াইশো কেজি ওজন সেগুলির। আজ থেকে তিন হাজার বছর আগে, এই বিপুল পরিমাণ ওজন বহন করেই কীভাবে খাড়াই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে ওঠানো হত— তা আজও রহস্যময়। বর্তমানে প্রযুক্তির দৌলতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয় পুলি। কোথাও আবার পাহাড়ের গায়ে গর্ত করে সেখানে স্থাপন করে রাখা হয় কাঠের বিম। সেই বিমগুলিকেই সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহার করা হয় মৃতদেহ উপরে নিয়ে যাওয়ার সময়। অবশ্য তার পরেও মৃতদেহ উত্তোলনের এই কাজ ঝুঁকিপূর্ণ যে-কোনো মানুষের কাছেই। আর সেই কারণেই হয়তো ধীরে ধীরে কমছে জনপ্রিয়তা। পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এই আশ্চর্য প্রথাটি। 

Powered by Froala Editor