প্রাতিষ্ঠানিক বাংলার ‘আস্ফালন’, কোণঠাসা পশ্চিমবঙ্গের মৌখিক ভাষাবৈচিত্র্যও?

“ভাষারও তো রাজনীতি আছে। বড়ো ভাষাগোষ্ঠী সবসময় গিলে খেতে চায় ছোটো ভাষাগোষ্ঠীকে। বাংলা ভাষাও সামিল হয়েছে সেই সাম্রাজ্যবাদের স্রোতে।” বলছিলেন সাহিত্যিক অভিমন্যু মাহাতো। পুরুলিয়ার ভূমিপুত্র অভিমন্যু আরও বলছিলেন, “সাঁওতালি, কুড়মালির মতো ভাষাগুলোকে আঞ্চলিক ভাষা বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। অথচ এদের বয়স প্রতিষ্ঠিত ভাষাদের চেয়ে অনেক বেশি। এমনকি তার শব্দভাণ্ডারকেও বাংলা শব্দ বা হিন্দি শব্দ বলে দখল করে নেওয়া হচ্ছে।” শুধুই যে অন্য ভাষা, তাই নয়। বরং বাংলা ভাষার মধ্যেও যে নানা ধরণের বৈচিত্র্য রয়েছে, তাকেও ক্রমশ এক ধারায় বেঁধে ফেলার চেষ্টা নতুন নয়।

দেখতে দেখতে ৭০ বছর পেরিয়ে গেল। সালাম-বরকতদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া ভাষার অধিকার আজও বাঙালির গর্ব। ২১ ফেব্রুয়ারির সেই ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতিতে দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। কিন্তু সত্যিই কি সমস্ত মানুষের মাতৃভাষার শরিক হয়ে উঠতে পেরেছে প্রাতিষ্ঠানিক বাংলা ভাষা? আজও গ্রামবাংলার মৌখিক ভাষার বিশুদ্ধ স্বর শুনলে অনেকেরই কপালে ভাঁজ পড়ে। ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ সহ্য করতে হয় অনেকক্ষেত্রেই। এমনকি গ্রামাঞ্চলের মানুষও ক্রমশ নিজেদের ভাষামূল হারিয়ে গ্রহণ করে নিচ্ছেন শহরের ভাষাকেই।

“শুধু গ্রামের ভাষা কেন, গ্রামাঞ্চলই তো হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। নিজস্ব জীবন নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শহুরে হয়ে উঠছেন মানুষ। মনে করছেন, একেই বলে আধুনিকতা। গ্রামের নিজস্ব পার্বণ, নিজস্ব জীবনের বেশিরভাগটাই তো আজ হারিয়ে গিয়েছে।” বলছিলেন তরুণ কবি সেলিম মণ্ডল। নদীয়ার চাপড়ার ভূমিপুত্র সেলিমের মতে, “কিছুদিন আগেও শহর থেকে মফঃস্বলে এবং মফঃস্বল থেকে গ্রামে মানুষের মুখের ভাষা যত দ্রুত বদলে যেত, আজ আর তেমনটা চোখে পড়ে না।” অবশ্য এর পিছনে প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকার কথা স্বীকার করতে রাজি নন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষার অধ্যাপক মোস্তাক আহমেদ। তাঁর কথায়, “ব্যবহারিক কাজের জন্য ভাষার একটা মান্য রূপকে তো স্বীকৃতি দিতেই হত। মান্য চলিত ভাষার মধ্যে মূলত কলকাতার মৌখিক ভাষার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ হলেও মনে রাখতে হবে সমস্ত মানুষের গড় উচ্চারণকে মান্যতা দিয়েই এই ভাষা তৈরি হয়েছে। তবে সাহিত্যের ক্ষেত্রে তো সেই গণ্ডি বারবার ভেঙে গিয়েছে। সেখানে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা উঠে এসেছে বারবার।”

একই কথা বলছিলেন সেলিম মণ্ডল। “উপভাষায় লেখা সাহিত্যের প্রতি কলকাতার মানুষেরই আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। আসলে তাঁরা জানতে চান অজানা জীবনকে।” কিন্তু বাস্তব জীবনে ভাষাগত কারণে বৈষম্য আজও সমানে চলেছে। নিজের ভাষা নিয়ে হীনমন্যতার ঘটনাও বিরল নয়। অধ্যাপক আহমেদের কথায়, “এখানেই প্রত্যেকের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রত্যেকের মুখের ভাষাকে সম্মান জানাতে শেখাটাও ভাষাশিক্ষারই একটা অঙ্গ।”

অবশ্য মানসিকতার পরিবর্তনও ধীরে ধীরে ঘটছে বলেই মনে করছেন উত্তরবঙ্গের সাহিত্যিক রাজা দাস এবং মেদিনীপুরের ভূমিপুত্র কবি অনিমিখ পাত্র। দুজনেই জানাচ্ছেন, ছাত্রজীবনে যেভাবে ভাষাগত কারণে কোণঠাসা হয়েছেন, আজ তার নমুনা প্রায় বিরল। রাজা দাসের কথায়, “উত্তরবঙ্গের সাহিত্যিকরা এখন স্বচ্ছন্দে সাহিত্যে নিজেদের মৌখিক স্বরকে তুলে ধরেন। সেখানে আর বিদ্রুপের আশঙ্কা করতে হয় না।” এমনকি আজই উত্তরবঙ্গে নিজস্ব সাহিত্য সংসদ তৈরির কাজও শুরু হতে চলেছে। তবে অনিমিখ পাত্রের মতে, “মান্য চলিত ভাষাকেই যেন ঠিক বলে ধরে নেওয়ার একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। তাই মেদিনীপুরের একজন যখন ‘করব না’ না বলে ‘করব নি’ বলে; তখন বলা হয় সে ভুল বলছে। অথচ ভাষা তো মানুষের মুখ থেকেই জন্ম নেয়। সেখানে প্রত্যেকটা বৈচিত্র্যই সঠিক।”

একদিকে যেমন সহনশীলতা বাড়ছে, অন্যদিকে তেমনই শিকড় হারাচ্ছে গ্রামবাংলার নির্ভেজাল জনজীবন। তথাকথিত আঞ্চলিক ভাষাগুলোকে উৎসাহ দিতে সরকারি উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে। আবার প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ ভুলে যাচ্ছেন নিজের শিকড়কেই। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যেন এক মিশ্র ফলাফলের ইঙ্গিত দিচ্ছে। পৃথিবীর অন্যতম বৈচিত্র্যপূর্ণ ভাষা বাংলা। ৫০-১০০ কিলোমিটারের মধ্যে তার চেহারা আমূল বদলে যায়। আগ্রাসনের মুখে কি হারিয়ে যাবে সেই বৈচিত্র্য? এর উত্তর অবশ্য সময়ই দেবে।

আরও পড়ুন
প্রসন্নকুমার ঠাকুরের হাত ধরেই আদালতে ঢুকেছিল বাংলা ভাষা

Powered by Froala Editor

More From Author See More