১৯৭৩ সাল। সেবছর সঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘দক্ষিণী’-র ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ঠিক হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের নষ্টনীড় গল্পটিকে মঞ্চস্থ করা হবে। আর তার জন্যই ডাক পড়ল ভীষ্ম গুহঠাকুরতার (Vishma Guhathakurata)। দক্ষিণীর প্রতিষ্ঠাতা শুভ গুহঠাকুরতার ছেলে ভীষ্ম। কিন্তু সংস্কৃতির জগত থেকে তাঁর অবস্থান বহু দূরে। ক্রিকেট খেলেই সারাদিন কাটিয়ে দেন। ২৪ বছরের ভীষ্ম তখন ফার্স্ট ডিভিশনের ক্রিকেট খেলোয়াড়। অভিনয়ের ডাক পেয়ে স্বাভাবিকভাবেই অবাক হয়েছিলেন। কিন্তু বাবার অনুরোধ তো অগ্রাহ্য করা যায় না।
২৫ বৈশাখ রবীন্দ্র সদনে শুরু হল নাটকের শো। কিছুক্ষণের মধ্যেই অমলের বেশে ঢুকলেন ভীষ্ম। নাটকটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেল। একটি দ্বিতীয় শো-এর অনুরোধও করল রবীন্দ্র সদন কর্তৃপক্ষ। আর সেই দ্বিতীয় শো দেখতেই দর্শকের আসনে হাজির পরিচালক তপন সিংহ। নাটকের শেষে ভীষ্মকে তিনি জানালেন তাঁর মুগ্ধ বিস্ময়ের কথা। শুভ গুহঠাকুরতার ছেলে হিসাবেই ভীষ্মকে চিনতেন তিনি। কিন্তু তিনি যে অভিনয়ও করেন, এই খবর তপন সিংহ জানতেন না। এইবার তাই আসন্ন সিনেমায় একটি চরিত্রের জন্য তিনি ভীষ্মকে বেছে নেওয়ার কথা জানালেন।
তপন সিংহের হাত ধরেই চলচ্চিত্র অভিনয়ের শুরু ভীষ্ম গুহঠাকুরতার। প্রথম সিনেমা ‘রাজা’। সেখানে একটি ছোটো চরিত্র। এরপর ‘হারমোনিয়াম’-এ আরেকটু বড়ো চরিত্র। এক গানের মাস্টার। তবে জীবনের আরেকটি বাঁক বদল অপেক্ষা করে ছিল। সেটা ঘটে গেল ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ সিনেমার সময়। মনোজ মিত্রের নাটক অবলম্বনে তপন সিংহের ছবি। আর তাতে বাঞ্ছারামের ভূমিকায় থাকছেন খোদ মনোজ মিত্র। তাঁর ছেলের ভূমিকায় বেছে নেওয়া হল ভীষ্মকে।
কাজটা সহজ ছিল না। কলকাতা শহরের পরিবেশে বেড়ে ওঠা, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের পড়ুয়া ভীষ্ম গুহঠাকুরতা অভিনয় করবেন একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামের এক যুবকের চরিত্রে। তপন সিংহ দেখিয়ে দিতে শুরু করলেন, কীভাবে চরিত্রটিকে আয়ত্ত করা যায়। চুল কাটা থেকে শুরু করে হাঁটাচলা – সবকিছুতেই গ্রাম্য প্রভাব ফুটিয়ে তুলতে শুরু করলেন তিনি। আর শেষ পর্যন্ত তা কতটা নিখুঁত হয়েছিল, দর্শকরা সকলেই জানেন। ভীষ্ম তাঁর উত্তর পেলেন ছবি মুক্তির পরদিনই। সকালে বাড়িতে সত্যজিৎ রায়ের ফোন। না, শুভ গুহঠাকুরতাকে নন। সত্যজিৎ খুঁজছেন তরুণ অভিনেতা ভীষ্মকে।
সত্যজিৎ রায় তখন দূরদর্শনের প্রযোজনায় হিন্দিতে একটি সিরিজ পরিচালনা করছেন। সিরিজের নাম ‘সত্যজিৎ রায় প্রেজেন্টস’। এই সিরিজেই প্রথম সত্যজিতের সঙ্গে কাজ করলেন ভীষ্ম। আর তারপর যেন রায় পরিবারেরই এক সদস্য হয়ে উঠেছিলেন ভীষ্ম।
‘সত্যজিৎ রায় প্রেজেন্টস’-এর দ্বিতীয় সিজনে দীর্ঘদিন পর ফিরলেন ফেলুদা। ‘যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে’ অবলম্বনে ‘কিসসা কাঠমাণ্ডু কা’। আর সেখানে ফেলুদার ভূমিকায় সত্যজিৎ বেছে নিয়েছিলেন শশী কাপুরকে। সব মিলিয়ে এক বিরাট আয়োজন। টিভি সিরিজ হলেও তা সিনেমার থেকে কোনো অংশে কম যায় না। আর এই পুরো আয়োজনের ব্যবস্থাপনার অনেকটা দিকও দেখতে হয়েছে ভীষ্মকে। তাঁর চরিত্রটি ছোটো। অভিনয় নিয়ে খুব বেশি ভাবনার দরকার নেই। কিন্তু বাকি সমস্ত কাজের দায়িত্ব নিয়েছেন অনায়াসে।
সত্যজিতের সঙ্গে যেমন একের পর এক ‘গণশত্রু’, ‘শাখা প্রশাখা’-তে অভিনয় করলেন তিনি। পরে সন্দীপ রায় ‘গুপী বাঘা ফিরে এলো’-তেও খুঁজলেন সেই ভীষ্ম গুহঠাকুরতাকেই। অন্যদিকে তপন সিংহের সঙ্গে ‘আদালত ও একটি মেয়ে’, ‘বৈদুর্য্য রহস্য’-এর মতো সিনেমার কাজ চলছিল। তপন সিংহের পরের দিকের ছবি ‘অন্তর্ধান’, ‘আতঙ্ক’-তেও বেছে নিলেন তাঁকে। পরবর্তীকালে সন্দীপ রায়ের সিনেমাতেও বারবার দেখা গিয়েছে তাঁকে। ‘বোসপুকুরে খুনখারাপি’ হোক বা ‘ডঃ মুন্সীর ডায়রি’ – ভীষ্ম গুহঠাকুরতাকে ছাড়া যে ফেলুদাকে নিয়ে সিনেমা অসম্পূর্ণ থেকে যায়, তা বারবার বুঝিয়ে দিয়েছেন সন্দীপ।
জীবনে তারকা হওয়ার উচ্চাশা কোনোদিন ছিল না তাঁর। খুব বেশি বড়ো চরিত্রেও কখনও দেখা যায়নি তাঁকে। ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ সিনেমায় সবচেয়ে বড়ো চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এছাড়া ‘আদালত ও একটি মেয়ে’ সিনেমায় কিছুটা বড়ো চরিত্রে কাজ করেছেন। তবে আপাতভাবে উপেক্ষিত চরিত্রগুলিকে জীবন্ত করে তোলায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। সেটা ‘বৈদুর্য্য রহস্য’ সিনেমায় গোয়েন্দার সহকারীর চরিত্রেই হোক বা ‘আতঙ্ক’-তে এক গুণ্ডাদলের সহকারী চরিত্রেই হোক। এভাবেই প্রায় আড়ালে থেকেই বিদায় নিলেন ভীষ্ম। গতকাল একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ভীষ্ম গুহঠাকুরতা। নীরবেই জানিয়ে দিয়ে গেলেন, তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে একটি অধ্যায়ের শেষ হয়ে গেল। অনেক গল্প এখনও শোনানো বাকি ছিল। তপন সিংহ বা সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে শুটিং-এর নানা অভিজ্ঞতার কথা কিছু কিছু লিখেছেন আগে। তবে আরও নানা অভিজ্ঞতার কথাই বাকি থেকে গেল। ভীষ্ম গুহঠাকুরতা আর কোনোদিন সেইসব গল্প শোনাবেন না।
তথ্যসূত্রঃ তপন সিংহের ফিল্ম মেকিং, সাক্ষাৎকারের দর্পণে নানা দিক, ভীষ্ম গুহঠাকুরতার সাক্ষাৎকার নন্দন মিত্র
কাঠমান্ডুতে স্বয়ং সত্যজিৎ রায়!, ভীষ্ম গুহঠাকুরতা, এইসময়
Powered by Froala Editor