মাইলের পর মাইল, অভুক্ত, হা-ক্লান্ত মানুষ ধুঁকতে ধুঁকতে পথ চলছে। কেউ কেউ রাস্তাতেই লুটিয়ে পড়ছে— কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, নেই কোনো উপশমের বন্দোবস্ত। শেষবেলায় মুখে জলটুকুও জোটে না তাদের। তারপর যখন সব জ্বালা, যন্ত্রণা জুড়িয়ে নিথর হল দেহ, তখন সে লাশ বেওয়ারিশ হয়ে পড়ে রইল সড়কের ধারে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করবে কে, কীভাবে? কাছে-পিঠে কোনো নদী থাকলে তাতে শব বিসর্জন দেওয়ার চেষ্টা করা যায় অবশ্য…
করোনা কবলিত ভারতবর্ষে এইভাবেই ঘরে ফিরেছে হাজারে হাজারে পরিযায়ী শ্রমিক। শহরে, গ্রামে অসুস্থ মানুষ মাথা কুটে মরেছে একটা অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য। উপচে পড়া হাসপাতালে জায়গা না পেয়ে হাটে, মাঠে, ঘাটে পোকামাকড়ের মত মরেছে লোকজন— দাহ হয়নি, মা জাহ্নবী তাদের অনেককে কোল দিয়েছেন বলে জানি। চেনা ছবি, পরিচিত গল্প…
বাংলা বা ভারতীয় মূলধারার চলচ্চিত্রে, গত আড়াই বছরের এই ভয়াবহ বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া যাবে না। চোখ বুজে সরাসরি অস্বীকার— যেন ওটা নেই, ওটা ছিল না। বায়োপিক আছে, ‘বাগবান কমপ্লেক্স’-এর হাত-ফেরতা মশলায় বানানো বুড়ো-বুড়ির প্রেমের সুড়সুড়ি আছে, আরও কত কিসিমের কত কী আছে মাথামুন্ডু। এই সময় মৃণাল সেনের বড়ো অভাব বোধ করি। মৃণাল (Mrinal Sen) থাকলে বীভৎস এই সাম্প্রতিক অতীত চাবুকের মতো আছড়ে পড়ত তাঁর সিনেমায়— ঘুমিয়ে পড়া, স্থবির, ক্লীব দর্শককে ঘাড় ধরে ঝাঁকুনি দিতেন। বলতেন, তোদের এই স্বমেহনের শিল্পচর্চায় আমি ‘ইয়ে’ করে দিই…
ঋত্বিক, সত্যজিৎ, মৃণাল— দেখতে দেখতে প্রত্যেকেরই একশো বছর পেরিয়ে গেল। এর মধ্যে ঋত্বিক দু-একটি বাদ দিয়ে সব সিনেমারই কেন্দ্রে রেখেছেন দেশভাগকে। চলচ্চিত্রের সংখ্যাও তাঁর বেহিসেবি, খামখেয়ালি জীবনের কারণে হাতে গোনা। সত্যজিৎ নান্দনিকভাবে উৎকর্ষ, পরিপূর্ণ, নিটোল সব চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন। তাঁর কাজ দেখে মনে হয় বড়ো বেশি নিখুঁত— সিনেমা দেখে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে ঘরে ফেরে দর্শক। এই ত্রয়ীর মধ্যে মৃণাল সেনই একমাত্র পরিচালক যাঁর চলচ্চিত্র সমসাময়িক বাস্তবতায় দর্শকের আত্মতৃপ্তিকে বিঘ্নিত করে বিরক্তির থেকে প্রশ্ন করতে প্ররোচিত করে। অস্থির করে, অস্বস্তি জাগিয়ে রাখে।
আরও পড়ুন
কানের মঞ্চে জন্মদিন পালন মৃণালের, প্রতিবছর দেখানো হত একটি করে ছবি!
বক্স অফিসের হিসেব মেলাতে যে পাকা ছিলেন মৃণাল তা তাঁর প্রথম অধ্যায়ের চলচ্চিত্র ‘নীল আকাশের নীচে’ বা ‘বাইশে শ্রাবণ’ দেখলে বোঝা যায়। সে পথ তিনি পরিহার করেছিলেন দ্বিধাহীনভাবে। ষাটের শেষ পর্ব থেকে সত্তর এবং আশির পুরোটাই তাঁর সক্রিয় উপস্থিতিতে উজ্জ্বল। উত্তাল সত্তরের অন্যতম যে বৈশিষ্ট্য সর্বতোভাবে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা, তা মৃণালের এই সময়কার ছবিতে ধরা রয়েছে। ‘ইন্টারভিউ’, ‘পদাতিক’, ‘কলকাতা ৭১’—শুধু বিষয়ের দিক থেকে আক্রমণাত্মক নয়, আঙ্গিকগতভাবেও বলিষ্ঠ ও সাহসী। চেনা ছকে ‘বই’ করবার বিকল্প এক ভাবনাকে উসকে তুলেছেন পরিচালক। দর্শক ধাক্কা খেয়েছে, ক্রুদ্ধ হয়েছে, বাতিল করতে চেয়েছে— সমাজের দাঁত, নখ বার করা আগ্রাসী চেহারাটা সরাসরি পর্দায় দেখতে কারো তো ভালো লাগে না। সত্তরের ছবির শীর্ষবিন্দু ‘কোরাস’। বোধহয় বাংলায় প্রথম সঠিক অর্থে রাজনৈতিক চলচ্চিত্র, যা লাতিন আমেরিকার চলচ্চিত্রের সঙ্গে এক কাতারে ঠাঁই পাওয়ার দাবিদার— আধা ঔপনিবেশিক এক অর্থনীতির নাভিশ্বাস, ভারাক্রান্ত ক্ষুধার নির্মম আলেখ্য।
আরও পড়ুন
‘মায়াবন্দরের দিকে’ পাড়ি দিলেন কবি মৃণাল বসু চৌধুরী, ফুরলো শ্রুতি আন্দোলনের অধ্যায়
‘নেকু-পুশু-মুনু’-র মেদবহুল ভিড়কে কখনো স্বস্তিতে থাকতে দেননি মৃণাল। আটের দশকের পণ্য-বিস্ফোরণে চোখে ধাঁধা লেগে যায় রাগী সত্তরের প্রতিনিধিদের— শুরু হল মধ্যবিত্তের হামলে পড়া ইঁদুর দৌড়। ‘চালচিত্র’-এর নায়কের বাড়িতে গ্যাস আসে— ছোটোখাটো সুবিধা হাসিল করতে করতে ‘সে’ যে কখন ‘খারিজ’-এ পালানের মৃত্যুর জন্য পরোক্ষে দায়ী হয়ে উঠবে, সে নিজেও ভাবতে পারেনি। মৃণালের ফর্ম ক্রমশ যেন এই পর্বে লোকরঞ্জক হয়ে উঠছে— বক্তব্য ঋজু ও তীক্ষ্ম। শ্লেষের ধার বেড়েছে। মূল্যবোধের অবক্ষয় পরিচালককে বেদনার্ত করেনি বরং সবাক প্রতিবাদী করে তুলেছে।
আরও পড়ুন
ঠাঁই হল না কলকাতায়, মৃণাল সেনের শেষ স্মৃতিচিহ্ন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে
‘আকালের সন্ধানে’-র একটি চরিত্র বলে যে বাবুরা আকালের ওপর চলচ্চিত্র বানাতে এলেন, আকাল আমাদের সর্বাঙ্গে। ৪৩-এর মন্বন্তর কোনো দূর-স্মৃতি নয়, সে রূপ বদল করে আশির দশকেও দিব্য বিদ্যমান। একদিকে ভোক্তা সমাজ হুড়মুড়িয়ে কেনার নেশায় বুঁদ অন্যদিকে হা-ঘরে, হা-ভাতেরা যে তিমিরে সেই তিমিরেই। অসম এই বিন্যাসে মৃণাল ধরেন গ্রাম পতনের শব্দ…
যেন এক সংকেতনবাহী গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন এই পরিচালক সমস্ত ধরনের নিষ্ক্রিয় আপোস ও গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়া মানসিকতার বিরুদ্ধে। দর্শকদের তিনি ‘শান্তির’ ঝিম ধরানো মোদক পরিবেশন করেননি। স্পর্ধিত হতে শিখিয়েছেন।
না, মৃণাল সেন কোনো বড়োসড় পরিবর্তনের কথা বলেননি— নিম্নবর্গের প্রতি-আধিপত্যের সুস্পষ্ট ভাষ্য তার চলচ্চিত্রে মিলবে না। মধ্যবিত্তের চিন্তার পরিসরকে একটু বড়ো করতে চেয়েছেন মাত্র, যা ক্রমান্বয়ে সঙ্কুচিত হয়ে চলেছে। আজ তাঁর প্রয়োজন আছে। মৃণাল সেনের জন্মশতবার্ষিকীতে এই কথাই মনে হয়।
Powered by Froala Editor