যিশু-হত্যার স্থানেই জন্ম পৃথিবীর প্রথম গির্জার, রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে দুই মুসলিম পরিবার

ডিসেম্বর মানেই উত্তুরে হাওয়া, কনকনে শীত। ডিসেম্বর মানেই, বড়দিন অর্থাৎ যিশুর জন্মদিন। পৃথিবীতে এসেছিলেন ঈশ্বরের দূত হয়ে, তাঁর জন্ম আকাশে নিয়ে এসেছিল নতুন তারা। ২৫ ডিসেম্বর পৃথিবীর প্রতিটি গির্জায় বেজে ওঠে ঘণ্টা; মোমের আলো আর প্রার্থনায় ভরে যায় সমস্ত চত্বর। আলো জ্বলে ওঠে সেপালকার গির্জাতেও— বিশ্বের প্রাচীনতম গির্জা। জেরুসালেমের পুরনো মহলের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র এটি। গোটা বিশ্বের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই গির্জা যেন স্বয়ং স্বর্গমহল। এখানেই যে ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন যিশু খ্রিস্ট…

ইতিহাস, ধর্ম, ঐতিহ্য, আবেগ— সমস্ত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ জেরুসালেমের এই সেপালকার গির্জা। সেই জেরুসালেম, যেখানে যিশুর লীলাখেলা। আর এই গির্জাও সেই সবকিছুর বাহক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে থেকে দেখলে একেবারে সাধারণ, পাথরের একটি প্রাচীন স্থাপত্য। কোনো জাঁকজমক নেই সেখানে, নেই বাহারি কাজ। কিন্তু ভেতরে ঢুকলেই দৃশ্য বদল। এক অপার শান্তি, সঙ্গে ইতিহাসের লুকোচুরি। সেপালকার গির্জা নিজেই যেন যিশুর আত্মাকে বহন করছে। বাইরে সাধারণ, অথচ ভেতরে অনন্ত সৌন্দর্য… 

গির্জার ইতিহাস বলতে গেলে ফিরে যেতে হবে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে। তখন বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের আধিপত্য শুরু হয়েছে। সিংহাসনে রাজা প্রথম কনস্টানটাইন। ইতিহাস বলে, রোমান রাজাদের মধ্যে ইনিই সর্বপ্রথম খ্রিস্টান হয়েছিলেন। যিশুর কবর খোঁজার জন্য তিনি নিজের মা হেলেনাকে জেরুসালেমের উদ্দেশ্যে পাঠান। সঙ্গে খ্রিস্টান পাদ্রি এবং লোকজনও ছিল। মনে রাখতে হবে, ততদিনে পুরনো জেরুসালেমের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। হয় ধ্বংস হয়ে গেছে, নয়তো মাটির তলায় চাপা পড়েছে। হেলেনারা জেরুসালেমে পৌঁছনোর পর শুরু হয় খননকাজ। আর সেই কাজ করতে করতেই সামনে আসে বেশ কিছু পাথর আর একটি প্রাচীন পাহাড়ি এলাকা। শুধু তাই নয়, মনে করা হয় এই কাজ করতে করতে সেখানের একটি মন্দিরও সরিয়ে ফেলা হয়। আর তার তলা থেকেই বেরিয়ে আসে একটি পাথরের সমাধি। তাহলে কি এটিই যিশুর শেষশয্যা? 

এর গভীরে আর যাননি তখনকার ঐতিহাসিকরা। তাঁরা বলছেন, জেরুসালেমে খননকাজ চালানোর সময় হেলেনারা দুটি জিনিস পান। এক, যিশুর পাথরের সমাধি এবং দুই, গলগাথা অঞ্চল- যেখানে যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল। এই জায়গাতেই কনস্টানটাইন আনুমানিক ৩২৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু করেন গির্জা নির্মাণ। তৈরি হয় ‘চার্চ অফ হোলি সেপালকার’, বা সংক্ষেপে সেপালকার গির্জা। ‘সেপালকার’ শব্দের অর্থ সমাধি বা কবর। যিশুর কবরের ওপরেই যেহেতু এই গির্জা তৈরি হয়েছিল, তাই তার এমন নাম। প্রসঙ্গত, এর আগে তৈরি করা কোনো গির্জার হদিশ পাওয়া যায়নি। ঐতিহাসিকভাবে, এটিই পৃথিবীর প্রথম গির্জা…     

কিন্তু এটুকু বললেই ইতিহাস শেষ হয়ে যায় না। ইতিহাস, এবং সেইসঙ্গে বর্তমানের মিশ্রণ— সব নিয়েই জলজ্যান্ত মিথ এই গির্জাটি। উপাসনা চলছিল প্রতিদিনের মতো। সেই কাজেই ছেদ পড়ল, যখন পার্সিয়ান ও মুসলিমরা জেরুসালেম আক্রমণ করেন। সে এক দীর্ঘ অধ্যায়। আর সেই রাস্তা ধরেই সামনে আসবে ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেডের প্রসঙ্গ। সপ্তম শতকে পার্সিয়ানদের হানায় প্রথমবার বিধ্বস্ত হয় সেপালকার গির্জা। তারপরই আসেন খলিফা হজরত উমর। তাঁর শাসন জেরুসালেম অবধিও পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু তিনি এই পবিত্র গির্জার ওপর কোনো আঁচ আসতে দেননি। 

কিন্তু তার পরবর্তী সময় এমনটা হয়নি। মুসলিম শাসন জেরুসালেমে আরও জাঁকিয়ে বসলে এই গির্জার ওপরও আঘাত নেমে আসে। ১০০৯ খ্রিস্টাব্দ। খলিফা আল-হাকিম নির্দেশ দেন, তাঁর শাসন অঞ্চলে খ্রিস্টানদের এমন উপাসনালয় থাকতে পারে না। অতএব, ভেঙে দাও গির্জাকে। সেই সময়টা ছিল সেপালকারের কালো অধ্যায়। খলিফার বাহিনী একেবারে তছনছ করে দেয় স্থাপত্যটি। প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়, যিশুর সমাধি ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হয়তো পৃথিবীর বুক থেকে সম্পূর্ণই মুছে যেত এই ঐতিহাসিক অঞ্চলটি। 

আরও পড়ুন
ক্রিসমাস থেকে এক্সমাস — শব্দের সঙ্গে জুড়ে আছে বড়োদিনের অদ্ভুত ইতিহাসও

এমন সময় শুরু হয় ক্রুসেড। ইতিহাসে এই প্রথম দুটি ধর্ম অস্ত্র হাতে নেমে আসে একে অন্যের বিরুদ্ধে। এই ক্রুসেড বহু মিথের জন্ম দিয়েছে, বহু স্থাপত্য রক্ষা ও ধ্বংসও করেছে। এই সময়ই সেপালকার গির্জার নতুন রূপে ফিরে আসা। নবম কনস্টানটাইন দায়িত্ব নিয়ে এই গির্জা পুনরুদ্ধার ও পুনঃস্থাপিত করার কাজ করেন। একটু একটু করে নতুনভাবে গড়ে ওঠে স্থাপত্যটি। 

প্রথমেই বলেছিলাম, গির্জাটি বাইরে সাদামাটা, ভেতরে ইতিহাস ও মিথের খনি। অবশ্য ইতিহাসের পথ চলা শুরু হয়েছে বাইরে থেকেই। গির্জার সামনেই আছে একটি সরু পথ, স্থানীয়রা বলেন ‘ভায়া ডলোরোসা’। পুরনো জেরুসালেমের এই পথ দিয়েই নাকি যিশুকে ক্রুশবিদ্ধের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আর আজকের গির্জা চত্বরটি ছিল গলগাথা। কাজেই ধরে নিতে হবে এই অঞ্চলটি মূল শহরের ঠিক বাইরে ছিল। অবশ্য কয়েক বছর আগেই সেপালকার গির্জার কাছে একটি প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। ঐতিহাসিকরা বলছেন, এটি রাজা হেরোডের প্রাসাদের অবশেষ হতে পারে। আর কে না জানে, এখানেই যিশুর অন্তিম বিচারসভা বসেছিল… 

ভেতরে ঢুকলে বেশ কিছু জিনিস আপনার নজরে আসবে। তার মধ্যে তিনটে জিনিস নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। প্রথম হল রক অফ ক্যালভেরি। একটি দেওয়ালের গায়ে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মূর্তি, চারিদিকে আলো এবং নিচে কাচঘেরা জায়গায় পাথর। মনে করা হয়, এটিই সেই জায়গা যেখানে যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল। আর পাথরদুটি সেই প্রাচীন গলগাথার অংশ। 

আরও পড়ুন
দক্ষিণেশ্বরে যিশুপুজো করেছিলেন রামকৃষ্ণ, সেই রীতি মেনেই আজও বড়োদিন পালিত হয় মিশনে

এরপর নজরে আসবে ‘স্টোন অফ অ্যানয়েনটিং’। আদতে এটি একটি মার্বেলের পাথর। একঝলক দেখে মনে হবে একটি পাথরের বিছানা। খ্রিস্টানরা মনে করেন, এখানেই মৃত যিশুকে ক্রুশ থেকে তুলে এনে রাখা হয়েছিল। তারপর তাঁর দেহকে পরিশুদ্ধ করে সমাধি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হয়। আর তৃতীয়টি হল ‘অ্যায়ডিকল’— সেপালকার গির্জার প্রধান জিনিস। ঠিক যেন গির্জার ভেতরে আরেকটি গির্জা। এক কামরার একটি মন্দিরের মতো অংশ; যার ভেতরে রয়েছে যিশুর সমাধি। ভেতরের ঘরের অবশ্য দুটি অংশ; একটি হল ‘অ্যাঞ্জেল’স স্টোন’, যে পাথরটি দিয়ে যিশুর সমাধি ঢাকা দেওয়া হয়েছিল। তার অল্প কিছু অংশই আজ অক্ষত রয়েছে। আর দ্বিতীয় অংশে রয়েছে যিশুর কবর। ভেতরে অবশ্যই কারোর দেহাংশ নেই; কারণ যিশুর মৃত্যুর তিনদিন পর তাঁর দেহ তো অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল! যিশু যে আবারও ফিরে এসেছিলেন, বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন পৃথিবীর সঙ্গে… 

এই কাহিনির কতটা সত্যি, কতটা মিথ সেটা তো ইতিহাস বলবে। যিশুর দেহ হারিয়ে যাওয়ার পেছনে কারণ কী, তা নিয়ে আজও গবেষণা চলছে। কিন্তু ওই যে কথায় বলে, বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু, তর্কে বহু বহুদূর! সেপালকার গির্জা আজও পৃথিবীর এক বিস্ময়। ইতিহাস ও মিথ যেখানে এসে মিশে গেছে। শেষ করা যাক অন্য একটি কথা বলে। ইতিহাস বলে, মুসলিম শাসকরা একটা সময় এই গির্জার প্রভূত ক্ষতি করেছিলেন। আর আজ এই পবিত্র, প্রাচীনতম গির্জার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে কিন্তু রয়েছেন দুই মুসলিম পরিবারই। নুসাইবাহ এবং জোদেহ— এই দুই মুসলিম পরিবার বংশ পরম্পরায় রক্ষা করে আসছে এই গির্জা। তাঁদের হাতেই যে গুরুদায়িত্ব। হিংসা, অত্যাচার, রক্ত, হত্যার বিপরীতে গিয়ে এই চিত্রটিই সবাইকে মিলিয়ে দেয়… 

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
কোকাকোলার বিজ্ঞাপনেই প্রথম জনপ্রিয় 'লাল পোশাকের' সান্টা ক্লজ