ধর্মতলা মোড় ছাড়িয়ে রাজভবনের দিকে হাঁটছেন আপনি। হঠাৎ ডানদিকে নজর পড়লেই দেখতে পাবেন ‘ডেকার্স লেন’ অথবা জেমস হিকি সরণী। দু'পা হাঁটলে চায়ের ভাঁড় হাতে বেঞ্চিতে একদঙ্গল অফিসফেরতা মানুষ। দেওয়ালের সাঁটা হ্যান্ডবিল। ‘নো মাস্ক-নো সার্ভিস।’ ধোঁয়া ওঠা চা'কে সঙ্গত করছে চপ কিংবা পকোড়া। বাটার টোস্ট- চিকেন স্টু সহযোগে কেউ গোগ্রাসে সারছেন অপরাহ্ন ভোজন। করোনা-রোধক মুখোশের ঠিকানা তখন বুকপকেট...
ডেকার্স লেন জুড়ে রয়েছে চিত্তরঞ্জন রায়ের নাম। প্রায় ৭২ বছর আগে মোহনবাগান টেন্টে চায়ের স্টল দিয়েছিলেন ওপার বাংলা থেকে চলে আসা কিশোর চিত্তরঞ্জন। তারপর রাধাবাজারের এক দোকান ঘর ভাড়া নিয়ে চলল ক'দিন। শোনা যায় রাধাবাজারের সেই ব্যবসা থেকে যা টাকা জমল, তাকে পুঁজি করেই ডেকার্স লেনেই পাকাপাকি ভাবে স্থায়ী হয়েছিলেন ‘চিত্তবাবু’। পঞ্চাশ টাকা সেলামিতে কেনা সেই ছোট্ট দোকানঘর আজ অফিসফেরতা বাঙালির পীঠস্থান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দোকান বেড়েছে কলেবরে। গরম গরম টাটকা খাবার পরিবেশন হয় প্রতিদিন। আজও সন্ধের পর খুদকুঁড়ো পড়ে থাকে না দোকানে। কিন্তু নতুন পদ যোগ করতে চান না কর্তৃপক্ষ।
‘না! আমাদের চা-টোস্ট-ডিমের ডেভিল-ফিসরোল কিংবা চিকেন স্টু হল গিয়ে বাঙালির ঐতিহ্য। চারপাশে পিজা-পাস্তা-বার্গার থাকা সত্ত্বেও, বাঙালি সেই ‘চিত্তবাবু’তেই ভিড় করে শিকড়ের টানে। আমরা শিকড়কে বদলাই কী করে?’
বলছিলেন বুবাইবাবু। গত কুড়ি বছর ধরে খদ্দের সামলাচ্ছেন তিনি। চিত্তবাবুর আত্মীয়দের সঙ্গে তাঁর আত্মার সম্পর্ক। ‘ওরা আমার ভাইয়ের মতো। একইসঙ্গে বেড়ে ওঠা। আসলে এটা তো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান না। এখানে যাঁরাই কাজ করেন তাঁরা একটা বিশাল পরিবারের সদস্য। কিছু বাঁধা খদ্দেরও আছেন সেই পরিবারে। তাঁরা আমাদের প্রত্যেককে নামে চেনেন। নিয়মিত খোঁজ খবরও নেন।'
২০০০ সালে চিত্তবাবুর মৃত্যুর পর দোকান চালাতেন তাঁর ভাই নারায়ণ চন্দ্র রায়। তাঁর পরে ব্যবসার হাল ধরেন চিত্তবাবুর দুই ছেলে সুবীর রায় এবং সুজয় রায়। ‘নিজেদের হাতেই মাছ কেনা কিংবা দোকানের বাজার করা। গুণমানের সঙ্গে কোনো আপোষ করে না দুজনেই।’ বাবা-কাকাদের মতোই পরিশ্রম করেই এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা, জানা গেল বুবাইবাবুর থেকে।
আরও পড়ুন
জাপানে ক্যাফে খুললেন রাসবিহারী বসু, বাঙালি খাবারের স্বাদে মাতোয়ারা সে-দেশের মানুষ
লকডাউনে চূড়ান্ত ক্ষতির মুখে পড়েছে কলকাতার বিভিন্ন স্ট্রিট ফুড বিপণী। ডেকার্স লেনও তার ব্যতিক্রম না। কিন্তু বুবাইবাবু গলাতে হতাশার তিলমাত্র রেশ পাওয়া যাবে না। তাঁর বিশ্বাস মানুষের ভালোবাসায় ভর করে ডেকার্স লেন আবার সেরে উঠবে...
‘এই প্যান্ডেমিকে ব্যবসার ক্ষতি তো কমবেশি হয়েছে। কিন্তু এই ক্ষতি শুধু আমাদের নয়, কলকাতার সমস্ত ছোটো ব্যবসায়ীদের। ৮ জুন যখন আবার দোকানের ঝাঁপ তুললাম, খবর পেয়েই প্রচুর মানুষ চলে এলেন। তবে আমরা মাস্ক ছাড়া কাউকে দোকানে বসতে দিচ্ছি না। একটি ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন ক'দিন আগেই তাঁদের একটি সমীক্ষায় ‘ডেকার্স লেন’কে কলকাতার সবচেয়ে সুরক্ষিত ‘স্ট্রিট ফুড হাব’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।’
আরও পড়ুন
কে সি দাসের দোকানে নিয়ে গিয়ে রসগোল্লা খাওয়াল ‘কিং কং’
মহামারীর পরিস্থিতিতে হাইজিন বজায় রাখতে গিয়ে বদল করা হয়েছিল দোকানের মেনুতেও। কাটলেট, ফিসরোল, চিকেন স্টু বা চিত্তবাবুর দোকানের বিখ্যাত মেটেকারি বানানো যায় গ্লাভস পরেই। কিন্তু ডেভিল? খালি হাতের পাক না পড়লে যে কোনোভাবেই ফুটে উঠবে না সিগনেচার স্বাদ। এমনকি গঠনও ভেঙে যাবে ভাজার সময়। তাই মেনু থেকে বাদ পড়েছে ডেভিল।
চায়ের গেলাস হাতে কথা গড়ায়। ‘প্রহর’ থেকে এসেছি শুনে, বুবাইবাবু কিছুতেই চায়ের দাম নিলেন না। উনি প্রহরের পাঠক। গলায় ঝরে পড়ল উচ্ছাস। ‘ভালো কাজ করছেন আপনারা...'
আরও পড়ুন
প্রতিদিন খাবার রেঁধে ৮৫ জন পড়ুয়ার বাড়িতে পৌছে দিচ্ছেন ইংল্যান্ডের শিক্ষক
‘চিত্তবাবু’ ছাড়িয়ে গলি বেয়ে দু'কদম গেলেই ‘রমেশবাবুর দোকান’। সেখানে মিলবে ‘মালাই টোস্ট’। দুধ-সর-চিনি-পাউরুটির এই অপূর্ব সমন্বয়, মিলিয়ে যাবে মুখে দিলেই। এছাড়া বাটার টোস্ট, চিকেন স্টু, ফ্রাই আর ডেভিল, আলুর দম তো আছেই। ময়দানের তাঁবু থেকে এককালে ‘রমেশবাবু’তেই খেতে আসতেন ফুটবলার শিশির ঘোষ। সেই দোকানের বয়সও যে পঞ্চাশ পেরিয়েছে…
লকডাউনের মধ্যে প্রবল ক্ষতির মুখ দেখেছে এসপ্লেনেড পাড়ার পুরোনো কেবিনগুলো। তবে দোকান খোলার পরেই আবার ভিড় জমেছে। পুজোর বাজার হাতে, চা সহযোগে ডিমের ডেভিলের টান বাধ্য করে কেবিনে হানা দিতে। কেউ কেউ আবার ক্রমাগত খোঁজ নিয়েছেন, ‘দোকান খোলা রয়েছে কিনা।’
অসুখ-ভয় কাটিয়েও জিতে যায় বাঙালির নস্টালজিয়া। যতদিন ধুলোধোঁয়া মাখা কলকাতা-যাপন বেঁচে থাকবে, হয়তো চিত্তবাবু-রমেশবাবুরা এভাবেই রয়ে যাবেন বাঙালির রসনায়...
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: চিত্তবাবুর দোকান, রমেশ বাবুর দোকান, আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়, সৌম্যদীপ গোস্বামী, শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
Powered by Froala Editor