স্টেডিয়াম জুড়ে ঠেসাঠেসি করে বসে রয়েছেন পাঁচ হাজার দর্শক। আর তাঁদের সামনে চেয়ারে বসে রয়েছেন শিল্পী। সামনে টেবিলের ওপর রাখা কাঠের গিটার। আর পিছনে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে সশস্ত্র কিছু প্রহরী। এবার গান গাইবেন তিনি। কিন্তু তার ঠিক আগেই বন্দুকের বাট দিয়ে থেঁতলে দেওয়া হল তাঁর আঙুল। রক্তাক্ত অবস্থায় অসহ্য যন্ত্রণা নিয়েই তিনি গিটার তুলে নিলেন কোলে। গান গাইলেন ভাঙা কণ্ঠেই। সেইসঙ্গে গেয়ে উঠল আরও পাঁচ হাজার কণ্ঠস্বর। তারপরই টেনে হিঁচড়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হল জনসমক্ষের আড়ালে। সেই শেষবারের জন্য ভক্তরা দেখেছিলেন তাঁকে। তারপর কানে এসেছিল অবিরাম গুলির শব্দ। ভিক্টর হারা। চিলির এই কিংবদন্তি অভিনেতা, কবি, শিক্ষক ও গায়ককে নৃশংসতার শিকার হতে হয়েছিল এভাবেই।
সেটা পঞ্চাশের দশকের শেষের দিক। উচ্চপদস্থ চাকরি ছেড়েই লনকেন শহরে ফিরেছিলেন হারা। দু’চোখে দিনবদলের স্বপ্ন। চোখের সামনে সারাদিনই যেন ভেসে বেড়াচ্ছে ম্যাক্সিম গোর্কির আগুনে পঙক্তিরা। সেই ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকা যায়? অভিনয় করতে হবে তাঁকে। না পারলে শিখতে হবে। সেই তাগিদ নিয়েই তিনি ভর্তি হলেন ইউনিভার্সিটি অফ চিলির কয়ার বিভাগে। শুরু হল থিয়েটার।
কিন্তু খুব বেশিদিন সেই বাঁধা-ধরা জীবনের মধ্যে নিজেকে আটকে রাখতে পারলেন না হারা। সেসময় চিলি মাতিয়ে রেখেছেন লোকসঙ্গীত শিল্পী ভায়োলেটা পেরা। তাঁর গানে মুগ্ধ হয়েই পথ পরিবর্তন করলেন হারা। তালিমও নিলেন তাঁর কাছ থেকে। আর তারপরই জড়িয়ে পড়া ল্যাটিন আমেরিকার লোকসঙ্গীত আন্দোলনে। সেই আন্দোলনই বদলে দিয়েছিল তাঁর জীবন। কিউবা, সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘুরে আসার পর তিনি যোগ দিলেন কমিউনিস্ট রাজনীতিতে। ততদিনে তাঁর লেখা গান ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ল্যাটিন আমেরিকায়। কিউবাতেও। মুখে মুখে সেসব গানের লাইন ঘুরে বেড়াচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষদের মধ্যে। কখনো আবার প্রতিরোধ গড়ে তুলছে অত্যাচারী শাসক দলের বিরুদ্ধে। ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম অ্যালবাম। এক কথায় যাকে বলে সুপারহিট।
এরপর এডুয়ার্ডো ও জুলিও কারাসকোর সঙ্গে জুটি বেঁধে তিনি তৈরি করলেন গানের দল ‘কুইলাপায়ুন’ (‘থ্রি বেয়ার্ডস)। শুধু গান লেখাই নয়, তিনিই ছিলেন এই ছোট্ট সঙ্গীত দলের ডিরেক্টর। বেরল অ্যালবামও। কিন্তু সেই অর্থে বাণিজ্যিকভাবে কোনো প্রদর্শনীই করেননি হারা। বরং চেয়েছিলেন মাটিকে আঁকড়ে থাকতে। সেই কারণে প্রতিবাদ মিছিলে, ট্রেড ইউনিয়নের বিক্ষোভ-অবস্থানেই কেবল আগুন ঝরাতেন হারা। নেতৃত্ব দিতেন গণসঙ্গীতে।
আরও পড়ুন
মঞ্চে উঠতে দেননি ডিলান, অপমানিত জোন বায়াজ বেরিয়ে এলেন সম্পর্ক থেকেও
এরই মধ্যে ১৯৬৯ ঘটে যায় এক অমানবিক ঘটনা। পুয়ের্তো মন্টে শহরে অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের ওপরে নির্বিচারে গুলি চালায় চিলির পুলিশ বাহিনী। প্রতিবাদে গর্জে উঠলেন হারা। লিখলেন ‘প্রেজুনতাস পোর পুয়ের্তো মন্টে’ (পুয়ের্তো মন্টে গণহত্যা নিয়ে কিছু প্রশ্ন)। সেই গানকে পাথেয় করেই চলল আন্দোলন। কিন্তু পরিস্থিতি বদলাল কি? হারা বেশ ভালোই বুঝতে পারলেন একমাত্র শাসক পরিবর্তনই সুদিন আনতে পারে দেশে। হাত মেলালেন কমিউনিস্ট পার্টি ‘পপুলার ইউনিটি কোয়ালিশন’-এর প্রধান সালভাদোর আইয়েন্দের সঙ্গে। হারা সস্ত্রীক যোগ দিলেন নির্বাচনী প্রচারে। গোটা চিলিকে আন্দোলিত করে তুলেছিল তাঁর ‘ভেনসেরেমোস’ গানটি।
আরও পড়ুন
অন্যদের বারণ সত্ত্বেও উড়ান, মাত্র ৫৩ বছরেই বিমান-দুর্ঘটনায় মৃত জন ডেনভার
“ফ্যাসিবাদী শৃঙ্খল ভেঙে
স্পন্দিত হবে নতুন ভোর
আমরা জিতব, আমরা বিজয়ী হবই
লেখা হবে ইতিহাস অমর…”
আরও পড়ুন
‘ইম্যাজিন ইফ জন ওয়্যার ডেড’; গুলি করার আগে, জন লেননের অটোগ্রাফ নিল হত্যাকারী
হ্যাঁ, তাঁর গানের সূত্র ধরেই পাল্টে গিয়েছিল গোটা চিলির রাজনৈতিক পরিস্থিতিই। ৫৭ শতাংশ ভোট পেয়েই জিতেছিলেন আইয়েন্দে। চিলিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক সরকার। কিন্তু সেই সরকারও টিকল না বেশিদিন। ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সেনা অভ্যুত্থান গ্রাস করে নিল চিলির পার্লামেন্টকে। বোমাবর্ষণে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল কমিউনিস্ট রেডিও সেন্টার। সিংহাসনে বসলেন স্বৈরাচারী শাসক পিনোসে। সেই অভ্যুত্থানের পিছনে হাত ছিল ‘গণতন্ত্রের ধারক’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও।
ফের প্রতিবাদের পথকেই বেছে নিলেন হারা। আর তার জেরে সেনা অভ্যুত্থানের ঠিক পরদিনই গ্রেপ্তার হতে হল তাঁকে। বন্দি করা হল চিলির জাতীয় স্টেডিয়ামে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী এবং প্রতিবাদে অংশগ্রহণকারী আরও হাজার পাঁচেক মানুষ। ‘কয়েদখানায়’ বসেই হারা লিখে ফেললেন নতুন গান। ‘ম্যানিফেস্টো’।
“আমার গিটার শাসকের পক্ষে নয়
গানেই বুনব আকাশ ছোঁয়ার পথ
আমৃত্যু আমি গেয়ে যাব এই গান…”
গোটা স্টেডিয়ামজুড়েই ধ্বনিত হতে লাগল ‘ম্যানিফেস্টো’। আর তারপর? যেখান থেকে শুরু হয়েছিল এই গল্প। পরদিন আঙুল থেঁতলে দিয়েই স্বৈরাচারী শাসক তাঁকে বাধ্য করেছিল এই গান গাইতে। কিছু দিন পর গণকবর থেকে কয়েকজন শ্রমিক উদ্ধার করেছিলেন তাঁর মৃতদেহ। তাতে গেঁথে ছিল ৪৬টি গুলি। না, ‘গান’ দিয়ে হারার গানকে থামাতে পারেনি চিলির সেনাবাহিনী। হাজার হাজার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের মধ্যে দিয়েই বেঁচে ছিলেন তিনি। আছেনও। গত বছরই চিলিতে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল তাঁর গান, “রাইট টু লিভ ইন পিস”।
ভিক্টর হারার সমস্ত রেকর্ডই ধ্বংস করে দিয়েছিল চিলির স্বৈরাচারী শাসক। কিছু রেকর্ড আর তাঁর নোটবুক নিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী জোয়ান হারা। পরবর্তীতে তিনিই সেগুলি অনুবাদ করেন ইংরাজিতে। শুধুই কি ইংরাজি? না, আশির দশকে বামপন্থী গণসঙ্গীতের হাত ধরে হারার গান ঢুকে পরেছিল বাংলাতেও। বঙ্গানুবাদ করেছিলেন কঙ্কন ভট্টাচার্য। ‘খোলা জানালার গান’ নামে বেরিয়েছিল সেই অ্যালবাম। সেখানে দেশ নেই, সময় নেই, ভাষার বিভেদও নেই। কেবলমাত্র অনুরণন লুকিয়ে আছে শ্রমজীবী মানুষের…
Powered by Froala Editor