ডেথ মেটাল সঙ্গীতকে করে তুলেছিলেন সর্বজনীন, প্রয়াত ‘চিলড্রেন অফ বডম’-এর অ্যালেক্সি লাইহো

“দ্য ক্ল্যাশ অফ উইকেডনেস ভেলস লেক বডম ব্লাড রেড
উই হ্যাভ গ্যাদার্ড আওয়ার সোলস টু প্রেইস দ্য ট্রায়াম্প অফ ডেথ”

মৃত্যু, রক্তপাত, ক্রূর বাস্তব, ঘৃণ্য হিংস্রতা— এসবই বার বার ফিরে এসেছে তাঁর কথায়। বার বার গানের সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জায়গা খুঁজে নিয়েছে মর্বিডিটি, মৃত্যু উদযাপন। আর সে জন্যেই হয়তো সত্তরের দশকে ফিনল্যান্ডের বডম লেকে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন নিজের ব্যান্ডের নাম হিসাবে। সেই হত্যাকাণ্ডে প্রাণ গিয়েছিল তিন কিশোরের। তবে বিচার পায়নি তারা। সেই ঘটনা নিয়ে গানও লিখেছিলেন তিনি। মৃত্যুর পিছনে ধাওয়া করতে করতেই চলে গেলেন কিংবদন্তি মেটাল গিটারিস্ট এবং গায়ক অ্যালেক্সি লাইহো।

বয়স হয়েছিল মাত্র ৪১ বছর। তাতেই থেমে গেল সঙ্গীতযাপন। গত বছর থেকেই সায় দিচ্ছিল না অ্যালেক্সির শারীরিক অবস্থা। গত সপ্তাহে হেলসিঙ্কিতে নিজের বাড়িতেই এই ‘যুদ্ধ’-এ ইতি টানলেন তিনি। গতকাল সন্ধেবেলা রেকর্ডিং স্টুডিও ‘নাপাম রেকর্ডস’-এর তরফে জানানো হয় তাঁর মৃত্যু সংবাদ। অ্যালেক্সি’র বর্তমান ব্যান্ড ‘বডম আফটার মিডনাইট’ থেকেও অফিশিয়াল সোশ্যাল মিডিয়া পেজে পোস্ট করা হয় শোকবার্তা।

১৯৭৯ সালে অ্যালেক্সির জন্ম ফিনল্যান্ডের এসপো শহরে। বছর সাতেক বয়সেই হাতেখড়ি গিটারে। বাড়িতেও ছিল রীতিমতো সঙ্গীতের পরিবেশ। বাবা ছিলেন পিয়ানো, অর্গান-বাদক। মা বাজাতেন বাঁশি। সেইসঙ্গে একজন গায়িকাও তিনি। এমন ক্লাসিক্যাল মিউজিকের আবহাওয়া থেকেই উত্থান তাঁর। বয়স তখন বছর দশেক। দিদি গিটার বাজিয়ে শুনিয়েছিল ‘গানস এন্ড রোসেস’-এর বিখ্যাত একটি গান। যে গান মোহিত করে দিয়েছিল অ্যালেক্সিকে। মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল জীবনের। তারপর পর থেকে তাঁর রেকর্ড প্লেয়ার বার বার বেজে চলত ‘জি এন আর’, ‘মল্টি ক্রু’, ‘স্কিড রো’, ‘টুইস্টেড সিস্টার’। 

কিশোর বয়সে আনুষ্ঠানিকভাবে গিটারের অ-আ-ক-খ শিখলেও, অ্যালেক্সি নিজের গিটার-বাদনের ধরণ ক্লাসিক্যাল থেকে মেটালে বিবর্তিত করেছিলেন বিভিন্ন রেকর্ড গান শুনে শুনেই। একরকম নিজেই ছিলেন নিজের শিক্ষক। ১৯৯৩ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে প্রথম মেটাল ব্যান্ড তৈরি করেন অ্যালেক্সি। নাম ছিল ‘ইনআর্থড’। পেশাদার সঙ্গীতকার হিসাবে আত্মপ্রকাশ সেই সময় থেকেই। 

তবে আঞ্চলিকভাবে খানিক পরিচিত হলেও, সেইভাবে জনপ্রিয়তা পায়নি কিশোর অ্যালেক্সি’র তৈরি প্রথম ব্যান্ড। অথচ নেশার মতো সারাদিন ঘিরে থাকত মেটাল মিউজিকের মোহ। সাফল্য না পেয়ে সেসময় আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছিলেন অ্যালেক্সি। এমনকি আত্মহননের চেষ্টাও করেছিলেন। বছর কয়েক আগে এক সাক্ষাৎকারে নিজেই প্রকাশ্যে আনেন সেই ঘটনা।

আরও পড়ুন
বৈষম্য ভেঙে ঐক্য ফেরাতে উদ্যোগ, বদলে গেল অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সঙ্গীত

তবে ফিনিক্স পাখিরা মরতে জানে না। বছর চারেকের মতোই আগুনের মতো উত্থান হয়েছিল আবার তাঁর ব্যান্ডের। প্রথম স্টেজ-শোয়ের আগেই ব্যান্ডের নাম বদলে যায় ‘চিলড্রেন অফ বডম’-এ। হ্যাঁ, বডম লেকের সেই হত্যাকাণ্ডের কথা মাথায় রেখেই এমন নাম বেছেছিলেন অ্যালেক্সি। তিনিই ছিলেন সে ব্যান্ডের ফ্রন্টম্যান।

ডিসটর্শন, দ্রুত লয়, জটিল সুরবিন্যাস, টেকনিক্যাল প্লেয়িং স্টাইল, মর্বিডিটি— এসব কারণের জন্যই ডেথ মেটাল গানের শ্রোতা সীমিত। তবে সেই বেড়াজাল ভেঙেই জনপ্রিয়তার প্লাবনে স্নান করেছিলেন অ্যালেক্সি লাইহো। ফিনল্যান্ডের গণ্ডি পেরিয়ে যে স্রোত গিয়ে পৌঁছেছিল যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এমনকি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতেও। আন্তর্জাতিক সঙ্গীতজগতে ট্রেডমার্কে পরিণত হয়েছিল ‘চিলড্রেন অফ বডম’। ২০০৮ সালে ‘চিলড্রেন অফ বডম’-এর ‘অ্যালবাম ব্লাডড্রাঙ্ক’ জনপ্রিয়তার নিরিখে বিশ্বের তালিকায় ২২ নম্বরে স্থান পেয়েছিল। এই সফলতা যে কোনো ডেথ মেটাল ব্যান্ডের ক্ষেত্রে বিরলতম বললেই চলে। তাছাড়াও ফিনল্যান্ডের সর্বকালীন বেস্ট-সেলিং গ্রুপ এখনও তাঁরাই। সব মিলিয়ে ফিনল্যান্ডে তাঁদের বিক্রি হয়েছিল আড়াই লক্ষের বেশি কপি। গিটার ওয়ার্ল্ড আন্তর্জাতিক পত্রিকায় পাঠকদের দ্বারা ‘সেরা মেটাল গিটারিস্ট’ হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। পেয়েছেন ‘গোল্ডেন গডস অ্যাওয়ার্ড’।

‘চিলড্রেন অফ বডম’ ব্যান্ডের হয়ে ১০টি অ্যালবামের কাজ করেছিলেন অ্যালেক্সি। তাছাড়াও ‘ওয়ারমেন’, ‘কেইলহালাট’, ‘সাইনারজি’, ‘দ্য লোকাল ব্যান্ড’-এর সঙ্গে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন তিনি। ২০১৫ সালে হেলসিঙ্কি ফেস্টিভালে পরিবেশন করেছিলেন স্বরচিত একগুচ্ছ গান। ‘১০০ গিটারিস্টস ফ্রম হেল’ নামাঙ্কিত সেই অনুষ্ঠানে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ১০০ জন গিটারিস্টকে। তাছাড়াও ‘বডম আফটার মিডনাইট’ সুপারগ্রুপের নেপথ্যেও রয়েছেন তিনি।

আরও পড়ুন
বিচ্ছেদের ৪৪ বছর পরে ক্ষমাপ্রার্থনা; বব ডিলান ও এক সঙ্গীতময় সম্পর্কের আখ্যান

২০১৯ সালে শেষবারের মতো ‘চিলড্রেন অফ বডম’-এর হয়ে তাঁকে দেখা গিয়েছিল স্টেজে। তারপর নিয়মমাফিক সঙ্গীতচর্চা চললেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে সাময়িক বিরতি নিয়েছিলেন তিনি। কে জানত সেই বিরতি চিরন্তনের হবে? 

তবে জনপ্রিয়তার জন্য যে মাদকতা ছিল তাঁর কৈশোরে। পরে সেখান থেকে অনেকটাই সরে গিয়েছিলেন তিনি। চাইতেন নির্জনে গান তৈরি করতে। সাত্ত্বিকতা নিজের লুকিয়ে থাকা সত্তার অনুসন্ধানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে বলেই বিশ্বাস করতেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “কত জন আমার গান শুনল, কে কী বলল— তাতে কিছু যায় আসে না আর। প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে বুঝেছি জনপ্রিয়তার জন্য সঙ্গীতজগতে আসিনি। মেটাল মিউজিককে ভালোবেসেছি, তাই বাজিয়েছি। এখানেই গল্পের শেষ...” তবে সত্যিই কি শেষ এখানে? ফিনিক্স পাখিরা মৃত্যু থেকেও জেগে উঠতে জানে। ঠিক সেইভাবেই বেঁচে থাকবেন অ্যালেক্সি লাইহো। আজও ক্লাসিক্যাল ছেড়ে মেটাল সঙ্গীতের স্বাদ পাওয়া যে কারোর হাতে-খড়ি হয় ‘চিলড্রেন অফ বডম’-এর গান দিয়েই। যা বজায় থাকবে আগামীতেও...

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
জার্মান সঙ্গীতজ্ঞের গান প্রকাশ্যে আনলেন মাইসোরের শেষ মহারাজা

More From Author See More

Latest News See More