মানুষের অজ্ঞাতে কখন মৃত্যু এসে হানা দেয়, তার খবর কে রাখে? মাত্র আগের রাতেই তো মায়ের কোলের কাছে খেলা করছিল দু’বছরের ছোট্ট শিশুটি। তারপর মা ঘুমিয়ে পড়ল। সেই ঘুম যে আর ভাঙবে না, সেকথা বোঝেনি অবোধ শিশু। তাই মায়ের চাদরঢাকা শরীরের কাছে গিয়ে বারবার চেষ্টা করছে ঘুম ভাঙানোর। কখনও চাদরের কোনা ধরে টান দিচ্ছে, কখনো নিজের মাথাটাই ঢুকিয়ে দিচ্ছে চাদরের ভিতর। তবু মায়ের ঘুম ভাঙছে না কেন? না, কোনো গল্প বা সিনেমা নয়; বাস্তব জীবনেই এমন মর্মান্তিক দৃশ্যের সাক্ষী থাকল ভারতবর্ষের করোনার দিনগুলি।
ঘটনাটি ঘটে সোমবার সকালে বিহারের মুজফ্ফরপুর স্টেশনে। সাম্প্রতিক লকডাউনের জেরে আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরাতে চালু হয়েছে বেশ কিছু স্পেশাল ট্রেন। তেমনই একটি ট্রেন ফিরছিল গুজরাট থেকে মধুবনী স্টেশনের উদ্দেশে। ট্রেনে অন্য অনেক শ্রমিকের সঙ্গে ছিলেন বছর ৩৫-এর এক মহিলা এবং তাঁর দুবছরের সন্তান। দীর্ঘ ট্রেন যাত্রায় প্রয়োজনীয় খাবার ও জল মেলেনি বলে অভিযোগ অনেক যাত্রীর। তার মধ্যে উত্তর ভারতজুড়ে চলছে প্রবল তাপপ্রবাহ। আর এই মিলিত আক্রমণের মুখে শেষ পর্যন্ত প্রাণ হারালেন মহিলা। মুজফ্ফরপুর স্টেশনে মৃতদেহ নামানো হলে ঘুম ভাঙে সন্তানের। আর তারপরেই সে মায়ের ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা চালাতে থাকে। স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেত্রী সেই মর্মান্তিক ঘটনার ভিডিও পোস্ট করেন সামাজিক মাধ্যমে। আর তারপরেই সমস্ত দেশে ছড়িয়ে পড়ে এই দৃশ্য।
সাম্প্রতিক লকডাউনের জেরে বিভিন্ন সময় সমস্যায় পড়তে দেখা গিয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের। ভিনরাজ্যে উপার্জন এবং আশ্রয় হারিয়ে কোনরকমে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন তাঁরা। ঘরে ফেরার উদ্দেশ্যে কেউ দীর্ঘ পথ হেঁটে বা সাইকেলে পাড়ি দিয়েছেন। পথে দুর্ঘটনার মুখে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন বহু শ্রমিক। আর এই সমস্ত ঘটনার নৃশংসতাকেই ছাড়িয়ে গেল বিহারের এই ঘটনা।
স্বাভাবিকভাবেই অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, এতগুলো মৃত্যুর দায় কার? অসহায় অভিবাসী শ্রমিকদের জীবনের সামান্য নিরাপত্তাও কি নিশ্চিত করতে পারি না সকলে মিলে? কিন্তু এসব তো বাইরের কথা। শিশুটি যখন টের পেল তার মা আর জাগবে না, তার মনে যে অভিমান জন্মাল, তা ঘোচাবে কে? এই শিশুটিও বড়ো হবে একদিন। জানতে পারবে, একদিন মায়ের ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করেছিল সে অসহায়ভাবে। ভাঙেনি। সে-জন্য সে যদি একদিন আপনার-আমার দিকেই আঙুল তোলে, চোখে চোখ রাখতে পারব তো?
Powered by Froala Editor