অন্য অসুখ; লকডাউনের মধ্যেই বাল্যবিবাহের ব্যাপক বৃদ্ধি দেশজুড়ে

দেশজুড়ে করোনা অতিমারীর চোখ রাঙানির মধ্যেই আরও একটি অসুখের প্রাদুর্ভাব বেড়েই চলেছে সকলের অলক্ষ্যে। সামাজিক এই অসুখের নাম, ‘বাল্যবিবাহ’। করোনা মহামারীকে সামলানোর জন্য চলতে থাকা লকডাউন পর্যায়েই দেশজুড়ে বাল্যবিবাহের সংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানানো হয়েছে নারী ও শিশু কল্যাণ দফতরের তরফে। মার্চ থেকে জুলাইয়ের মধ্যে দক্ষিণ ভারতের মাইসুরু জেলাতেই শুধুমাত্র একশোটি বাল্যবিবাহের খবর পাওয়া গেছে। সুতরাং সারা দেশে ছবিটা কতটা ভয়াবহ, তার একটা আন্দাজ করে নেওয়াই যায়।

এর আগে গত এপ্রিল মাসে জাতিসংঘের প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে, করোনা মহামারী ঝুঁকির সামনে ফেলে দিয়েছে অন্তত ৪০ লক্ষ কিশোরীর জীবন। ভয়ংকরভাবে যে বাল্যবিবাহের পরিমাণ বাড়তে চলেছে, সেই বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল ওই রিপোর্টে। বাস্তবে যেন তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে দেশজুড়ে। দক্ষিণ ভারতের ভেলোর, তিরুভান্নামালাই-এর মতো অঞ্চলেও একাধিক বাল্যবিবাহের খবর সামনে এসেছে লকডাউনের সময়েই।

লকডাউন পর্যায়ে দেশজুড়ে বাড়তে থাকা দারিদ্র্য এবং সরকারি আধিকারিকদের করোনা অতিমারী সামলাতেই অত্যধিক ব্যস্ত হয়ে পড়ার সুযোগ নিয়েই এই অসুস্থ প্রথা আবার বৃদ্ধির পথ ধরেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ‘ওয়ার্ল্ড ভিশন’ নামক একটি সংস্থার বাল্যবিবাহ বিশেষজ্ঞ এরিকা হল জানিয়েছেন, যে কোনও ধরনেরই দুর্যোগ অথবা মহামারী এলে বাল্যবিবাহের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে দেখা গেছে আগেও। দ্রুত সাবধান হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তাই তিনি। যোগ করেছেন, যদি আমরা অপেক্ষা করে থাকি যে কবে এই মহামারী অতিক্রান্ত হবে এবং তারপর এই এই বিষয়টিকে নিয়ে ভাবনা চিন্তা করা শুরু হবে, ততদিনে অত্যন্ত দেরি না হয়ে যায়!

লকডাউনের সময় দেশজুড়ে সমস্ত বিদ্যালয়গুলি বন্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল সরকারের তরফে। স্বাস্থ্যবিধির নিরিখে একান্তই প্রয়োজনীয় ছিল সেটা। লকডাউন বিধি মানতে জনস্বাস্থ্য কর্মীদেরও ফিল্ডওয়ার্ক বন্ধ হয়ে যায় প্রায়। সেই সুযোগ নিয়েই এই কুপ্রথার আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার কারণ বলে মনে করছেন জনসাস্থ্য কর্মীদেরই একটি বড় অংশ।

আরও পড়ুন
ভারতেই জন্ম, বিবাহ, এমনকি মৃত্যুও – এভাবেই জড়িয়ে পড়েছিল শেক্সপিয়রের পরিবার

যদিও সরকারি তরফে বলা হয়েছে যে বেশিরভাগ বাল্য বিবাহের ঘটনা ঘটার সময় প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল সেগুলি। কিন্তু পরবর্তীকালে লকডাউনের সুযোগ নিয়ে আবার তাদের বাবা-মায়েরা বিয়ের আয়োজন করলে আর কিছু করার ছিল না বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে কর্তৃপক্ষের তরফে।

কিন্তু এত বাড়াবাড়ি সবার চোখ এড়িয়ে গেল কী করে? সরকারের দিক থেকে দায়ী করা হচ্ছে বাল্যবিবাহের সঙ্গে যুক্ত পরিবারগুলিকেই। সরকারের যুক্তি, লকডাউনের সময়ে অতিথি-অভ্যাগত কিংবা পাড়া-প্রতিবেশীদের নিমন্ত্রণ না করেই চুপিসাড়ে চার দেওয়ালের মধ্যে সেরে ফেলা যায় বিয়ে। মন্দিরে যাওয়া বা বাড়ি ভাড়া করে লৌকিকতার প্রয়োজনও পড়ে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বর্ধিত ছুটিও পালে হাওয়া দিয়েছে এই প্রবণতার।

আরও পড়ুন
বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে লড়াই মধ্যপ্রদেশের দুই তরুণীর, পেয়েছেন রাষ্ট্রপুঞ্জের স্বীকৃতিও

কতটা ভুল এবং অস্বাস্থ্যকর এই বাল্য বিবাহ প্রথা? সরকারি বিজ্ঞাপনেই বলা হয় বারবার, শুধুমাত্র শারীরিক নয়, মানসিক ভাবেও ধ্বংস হয়ে যেতে পারে কম বয়সে বিয়ে হওয়া মেয়েরা। অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের পর আসতে পারে গর্ভপাতের আশঙ্কা; বাচ্চার জন্ম দিলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারও অপরিণত এবং অপুষ্টির কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।

ইউনিসেফের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে কুড়ি কোটিরও বেশি মেয়ের বিয়ে বাল্য অবস্থাতেই হয়ে থাকে, যাদের মধ্যে ১৫ বছর পার হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায় ১০ কোটি বালিকার। বর্তমানে ভারতীয় আইন অনুযায়ী মেয়েদের ১৮ বছর এবং ছেলেদের ২১ বছরের আগে বিয়ে হওয়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। বিয়ের পরেও গর্ভবতী হওয়ার ক্ষেত্রে মেয়েদের সচেতন করতে আইন না থাকলেও, শারীরিক অবস্থার কথা ভেবে স্লোগানই করা হয়েছে, আঠেরোর আগে বিয়ে নয়, একুশের আগে মা নয়। তবুও এত প্রচার, টিভিতে, কাগজে কিংবা লিফলেট জুড়ে বিজ্ঞাপনের পরেও কি বদলাচ্ছে ছবিটা সেভাবে? প্রদীপের নিচে অন্ধকার কিন্তু অন্য বার্তাই দিচ্ছে!

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More