বাক্সবন্দি কবর শিশুর, ফিরে আসছে ভ্যাম্পায়ারের গল্প

পোল্যান্ড (Poland) দেশের ছোট্ট গ্রাম পিয়েন। সেখানের একটি অতিপ্রাচীন কবরস্থানে পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন একদল প্রত্নতাত্ত্বিক। খননকালে একটি শিশুর বাক্সবন্দি কবর আবিষ্কার করে চোখ কপালে উঠল তাঁদের। শিশুটিকে যেভাবে কবর দেওয়া হয়েছে, মধ্যযুগের ইউরোপে সেভাবে কবর দেওয়া হত ভ্যাম্পায়ারের হাত থেকে বাঁচতে। তবে কি সত্যিই ছিল ভ্যাম্পায়ারের (Vampire) অস্তিত্ব?

২০২৩-এর জুলাই মাসে সপ্তদশ শতকের কবরখানায় পাওয়া সমাধিটি নিয়ে ফের মাথাচাড়া দিয়েছে সেই প্রশ্ন। পরীক্ষকদের মতে শিশুটির বয়স পাঁচ-ছয়। কার্বন-ডেটিং অনুযায়ী প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে সমাধিস্থ করা হয়েছে দেহটিকে। পায়ে পরানো একটি বিশালাকৃতি তালা। কবরের মাটিতে উলটো করে মুখ গুঁজে পড়ে আছে শিশুটির দেহ। প্রচলিত মতে রক্তচোষায় পরিণত হওয়া মানুষকে এরকম ‘ভ্যাম্পায়র-বিরোধী’ পদ্ধতিতে কবর দেওয়া হত।

তবে কবর উদ্ধারের ঘটনা এখানেই শেষ নয়। গতবছরও পোল্যান্ডের অন্যপ্রান্তে পাওয়া গেছিল একটি পূর্ণবয়স্ক মহিলার কঙ্কাল। তাঁর পায়েও ছিল তালা। গলার দু-পাশে আড়াআড়ি করে রাখা ছিল একটি কাস্তে। যেন প্রাণ ফিরে পেয়ে উঠতে গেলেই দু-ভাগ হয়ে যাবে ভ্যাম্পায়ারের গলা। 

ইউরোপীয় লোকপুরাণে ভ্যাম্পায়ারের গল্পের বয়স প্রায় হাজার বছরের কাছাকাছি। মোটামুটি একাদশ শতাব্দী থেকেই তৈরি হতে থাকে রক্তচোষা মানুষের হাড়-হিম করা কাহিনি। যা ক্রমে গণসন্ত্রাসের চেহারা নেয়। ভ্যাম্পায়াররা মানুষের রক্ত শুষে খায়, মৃত্যুর পরেও তারা ফিরে আসে ইত্যাদি গল্পকথায় পরিপূর্ণ হয়ে আছে ইউরোপের সাহিত্য-চলচ্চিত্রের ঝুলি। সেখানেও এই পদ্ধতিতেই ভ্যাম্পায়ারদের চিরকালের জন্য কবরস্থ করা হত।

আরও পড়ুন
জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছিল আলেকজান্ডারকে? ঐতিহাসিকদের গবেষণায় উঠল প্রশ্ন

তবে কি এক্ষেত্রেও ঘটেছিল সেরকম ঘটনা? বিশেষজ্ঞদের গবেষণা অবশ্য অতোটা রোমহর্ষক নয়। বরং ভ্যাম্পায়ারের গুজবের পিছনে পাওয়া গেছে কিছু যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা। মধ্যযুগের ইউরোপে প্রায়ই লেগে থাকত মহামারি। প্লেগের মতো রোগ তো ছিলই, আরও অসংখ্য নাম না জানা রোগে মৃত্যু ঘটত মানুষের। বর্তমান পোল্যান্ড দেশসহ পূর্ব ইউরোপে ১৬০০ সাল নাগাদ শুরু হয় কলেরার প্রাদুর্ভাব। মারা যায় বহু মানুষ। এক সঙ্গে অনেক মৃত্যু হলেই তখন দায়ী করা হত অতিলৌকিক শক্তিকে। অজানা কারণে মৃত মানুষকে মন্ত্রতন্ত্রের সাহায্যে বন্দি করে রাখা হত। সেই স্বাভাবিক অজ্ঞতা থেকেই জন্ম নিয়েছিল ভ্যাম্পায়ারের গল্পকথা। 

আরও পড়ুন
কবর থেকে কঙ্কাল তুলে পরানো হয় নতুন পোশাক, নেওয়া হয় ফ্যামিলি ফটোগ্রাফও!

বিশেষত স্লোভাকিয়া-হাঙ্গেরিসহ পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এই ধরনের কাহিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়। মৃতদের পায়ে শিকল বেঁধে, বুকের মধ্যে ইস্পাতের ধারালো দণ্ড ঢুকিয়ে, মৃতদেহের মুখে মন্ত্রপূত কয়েন ঢুকিয়ে তাঁদের বন্দি করা হত। তবে আত্মহত্যা বা ব্যাপ্টাইজ না হওয়া মৃতদেরকেও এভাবেই কবর দেওয়ার পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। 

সেই সূত্রেই উঠে আসছে ইউরোপের ধর্মীয় সংঘাতের নিজস্ব ইতিহাস। অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে ক্যাথলিক-প্রোটেস্টানদের মতবিরোধ তীব্র আকার নেয়। যেখানে ক্যাথলিক চার্চ শক্তিঅর্জন করতে পেরেছিল, সেখানে বিভিন্ন লোকবিশ্বাসকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলে। ফিরে আসে শয়তান আর ডাকিনীর ভয়। এই কবরগুলি তারও প্রমাণ হতে পারে বলে অনেক গবেষকের বিশ্বাস।

আপাতত প্রশ্নের মুখে ঝুলে সাড়ে তিনশো বছর পুরনো একটি মৃতশিশুর ইতিহাস। নিছক লৌকিকভাবেই মৃত্যু ঘটেছিল? নাকি সত্যিই পৈশাচিক কোনো শক্তির সাক্ষ্য দেবে সে? গবেষণার ফলাফল যাই বলুক না কেন, মানুষের কল্পনার দৌড়কে সে আবার জাগিয়ে দিতে পেরেছে।

Powered by Froala Editor