খিদে মেটাত মাটির তৈরি বিস্কুট ‘ছিকর’, প্রচলন ছিল প্রতিবেশী বাংলাদেশেই

বছর খানেক আগের কথা। আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশ এবং হাইতির কিছু ছবি ভাইরাল হয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। পেটের জ্বালা মেটাতে নিরুপায় হয়ে মাটির বিস্কুটই খাচ্ছেন মানুষ। তবে এই মাটির বিস্কুটের চল খুঁজতে সুদূর আফ্রিকায় না গেলেও চলবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশেও একসময় নিম্নবিত্তদের খিদে মেটানোর প্রধান সামগ্রীই হয়ে উঠেছিল এই মাটির বিস্কুট। 

সময়টা সত্তর কি আশির দশক হবে। বাংলাদেশ জুড়ে তখন মুক্তিযুদ্ধের আবহ। তথৈবচ অবস্থা সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির। কিন্তু খিদে কি স্বাধীনতার স্বাদ বোঝে? তাকে শান্ত করতেই তাই প্রচলন শুরু হয়েছিল পোড়ামাটির বিস্কুটের। নবীগঞ্জ, হাবিবগঞ্জ, সিলেটের বিভিন্ন অংশেই নিম্নবিত্ত মানুষের খাদ্যতালিকায় জায়গা করে নিয়েছিল এই বিস্কুট। 

তবে পরবর্তী সময়ে আর্থিক পরিস্থিতি পাল্টালেও খাদ্যতালিকা থেকে বাদ পড়ল না এই বিস্কুট। ‘লোকখাদ্য’ হিসাবেই রয়ে গেল সে। এমনকি জনপ্রিয়তা এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে নগদ অর্থের পাশাপাশি চালের বিনিময়েও ক্রেতারা সংগ্রহ করতেন এই বিস্কুট। বিশেষ করে গর্ভবতীরা এই বিস্কুট খেতে পছন্দ করতেন, উঠে আসে এমন তথ্যও। মনে করা হত অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের বিকাশ এবং সন্তানের পুষ্টিসাধনের জন্য বিশেষ উপযোগী এই মাটির বিস্কুট ‘ছিকর’।

হ্যাঁ, এমনই অদ্ভুত নাম এই বিস্কুটের। ‘ছিকর’ কথাটি এসেছে মূলত ফরাসি শব্দ থেকেই। ফরাসি ‘ছিয়া’ শব্দের অর্থ কালো। এবং ‘কর’ মানে মাটি। কালো বা এঁটেল মাটি দিয়েই এই বিস্কুট তৈরি হত বলেই এমন নাম। কিন্তু কীভাবে ফরাসি শব্দ মিশে গেল বাংলা সংস্কৃতিতে? 

উত্তর খুঁজতে পাড়ি দিতে হবে প্রায় এক শতাব্দী আগে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশের পাশাপাশি বাংলায় বিক্ষিপ্তভাবে ফরাসি আধিপত্যও কায়েম ছিল তখন। বিভিন্ন নির্মাণ কাজের জন্য তাঁরা বাংলা থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে যেতেন কালো এঁটেল মাটি। সেই ফরাসি শব্দই ‘ছিয়াকর’-ই পরে ফিরে আসে ‘ছিকর’ হয়ে।

তবে যে কোনো এঁটেল মাটি হলেই তা দিয়ে তৈরি করা যায় না এই বিস্কুট। বাংলাদেশের হাবিবগঞ্জ, বানিয়াচং, বাহুবল, মাধবপুর প্রভৃতি এলাকায় রয়েছে বহু ছোটো ছোটো টিলা। এই টিলার ভেতরে গর্ত করে সংগ্রহ করা হত মিহি নরম মাটি। তাকে জলে ভিজিয়ে প্রথমে তৈরি করা হত মণ্ড। বিভিন্ন প্রয়োজনে তাকে আকার দেওয়া হত বিভিন্ন রকম। কখনও নেহাতই বর্গাকার বিস্কুট, আবার কখনো তাকে দেখতে হত ললিপপ বা লজেন্সের মতো। তারপর তা প্রথমে রোদে শুকিয়ে ও পরে বিশেষভাবে তুষের আগুনে পুড়িয়ে তৈরি হত ‘ছিকর’ বিস্কুট। ছিকর তৈরির বিশেষ এই এঁটেল মাটির নামই পরবর্তীকালে হয়ে যায় ‘ছিকনা মাটি’। 

আরও পড়ুন
আঙুলের ছাপ নেই তিন প্রজন্মের – বাংলাদেশেই আছে বিস্ময়কর পরিবার

আজও বাংলাদেশের বেশ কিছু অংশে প্রচলিত আছে ‘ছিকর’। তবে কমেছে তার জনপ্রিয়তা। মাটির এই বিস্কুটের মধ্যে আদৌ যে পুষ্টিকর কোনো গুণ নেই, তাও বুঝেছে মানুষ। ফলে এক প্রকার প্রায় অবলুপ্তির পথেই হাঁটছে ছিকরশিল্প। পেশা পাল্টেছেন অধিকাংশ ছিকর প্রস্তুতকারী মৃৎশিল্পীই। তবুও মৃতপ্রায় এই শিল্পই যেন আজও মনে করিয়ে দেয় অতীতের অন্ধকার সময়কে। মনে করিয়ে দেয় শোষণ আর অনটনের মধ্যে লড়াই করতে থাকা বাংলার নিম্নবিত্ত সমাজের কথা। বছর পেরিয়ে সেই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেয়েছে বাংলা। কিন্তু হাইতির মতো দেশ এখনও চালিয়ে যাচ্ছে সেলড়াই। খিদের সঙ্গে অনটনের এক আজন্মকালীন সংগ্রাম। পূর্ণিমার চাঁদ পারতপক্ষেই সেখানে ঝলসানো রুটি। কবে মুক্তি মিলবে তাঁদের? উত্তর জানা নেই...

Powered by Froala Editor