কারাবন্দিদের কাঠের কাজ শিখিয়ে পদ্মশ্রী অজয়ের

কেউ জড়িত ছিলেন মাওবাদী আন্দোলনের সঙ্গে, কেউ একাধিক হত্যাকাণ্ডের অপরাধী, আবার কেউ আবার জড়িয়ে চোরাশিকার কিংবা নর্মদা উপত্যকার মাফিয়া রাজত্বের সঙ্গে— এঁদের সকলের কাছেই তিনি ‘গুরুজি’। অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনে এক চিলতে আলোর রশ্মি। 

অজয় কুমার মান্ডবী। বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে কারাবন্দিদের নতুন জীবনের অনুসন্ধান দিয়ে চলেছেন ৫৫ বছর বয়সি ছত্তিশগড়ের এই কাষ্ঠশিল্পী। প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার। হাতিয়ার হস্তশিল্প, ক্যালিগ্রাফি। এবার এই আশ্চর্য কর্মকাণ্ডের জন্যই ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মশ্রীতে ভূষিত হলেন তিনি।

শৈশব থেকেই কাঠ ও কাদামাটি দিয়ে খেলনা তৈরি করার আগ্রহ ছিল অজয় কুমারের। পরবর্তীতে সেটাকেই পেশা করে নেন তিনি। ছত্তিশগড়ের ঐতিহ্যবাহী কাঠ খোদাই শিল্পই হয়ে ওঠে তাঁর জীবিকা এবং সৃজনীর অন্যতম মাধ্যম। 

বছর বারো আগের কথা। ২০১০ সালে তাঁর হস্তশিল্পতে মুগ্ধ হয়েই ছত্তিশগড়ের কাঙ্কের জেলার জেলা কালেক্টর দ্বারস্থ হয়েছিলেন তাঁর কাছে। অনুরোধ করেছিলেন, কারাবন্দিদের এই শিল্পের প্রশিক্ষণ দিতে। না, তাঁকে ফেরাননি অজয়কুমার। বরং, সাগ্রহেই এই বিপুল কর্মকাণ্ডে নিজেকে সামিল করেছিলেন তিনি। 

অবশ্য খুব কিছু সহজ ছিল না এই কাজ। এটা যে-সময়ের কথা হচ্ছে, তখন ছত্তিশগড় জুড়ে চরম পর্যায়ে চলছে নকশাল ও মাওবাদী আন্দোলন। প্রথমত, অজয় কুমারকে শিক্ষক হিসাবে গ্রহণ করতে চাননি অধিকাংশ কারাবন্দি। মাত্র ১২ জনকে নিয়েই পথ চলা শুরু হয়েছিল তাঁর। অন্যদিকে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় গ্রেপ্তার না হওয়া মাওবাদী যোদ্ধাদেরও চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তবে ধীরে ধীরে বদলাতে থাকে এই ছবি। কালেক্টর সাহেবের মতোই তাঁর হস্তশিল্প এবং বিনম্র আচরণে বশীভূত হয়েছিলেন দুঁদে মাওবাদীরাও। আপন করে নিয়েছিলেন ‘গুরুজি’-কে। 

পরিসংখ্যার দিক থেকে দেখতে গেলে ২০১০ সাল থেকে ক্রমশ বেড়েই চলেছে তাঁর শিক্ষার্থীর সংখ্যা। এখনও পর্যন্ত ৪৫০-র বেশি কারাবন্দিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি। যার মধ্যে শতাধিক মানুষ বর্তমানে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। ফিরেছেন সমাজের মূল স্রোতে। যাঁরা এখনও পর্যন্ত মুক্তি পাননি কারাগার থেকে, তাঁরাও পেয়েছে স্বাধীনভাবে বাঁচার রসদ। ২০১৫ সালে কাঙ্কের জেলের কারাবন্দিদের ‘শান্তা আর্ট’ নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলেন অজয় কুমার। কারাবন্দিদের তৈরি হস্তশিল্পী এই সংগঠনের মাধ্যমেই রপ্তানি হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ফলে, কারাগারে বন্দি থেকেও তাঁরা আর্থিক সাহায্য পাঠাতে পারছেন পরিবারের কাছে। তা-ই বা কম কী? সবমিলিয়ে অজয়কুমারের এই উদ্যোগ সম্পূর্নভাবে বদলে দিয়েছে ছত্তিশগড়ের সহিংস, রক্তক্ষয়ী পরিমণ্ডলকে…

Powered by Froala Editor

More From Author See More