প্রয়াত ‘পিডিএফ’-এর জন্মদাতা চার্লস গেশকে

বাড়ির পিছনে ছোট্ট একটা গ্যারেজ। না, কোনো গাড়ি থাকে না সেখানে। ধুলোর আস্তরণে সেখানে চাপা পড়ে থাকে বাড়ির অপ্রয়োজনীয়, পুরনো জিনিসপত্র। এক কথায় স্টোররুম বলাই চলে। ধুলো-টুলো ঝেড়ে সেখানেই খুলল ছোট্ট অফিস। কর্মী মাত্র দু’জন— চার্লস গেশকে এবং জন ওয়ার্নক। তাঁরাই মালিক এই কোম্পানির। ১৯৮২ সাল। আজ থেকে প্রায় চার দশক আগে এভাবেই পথ চলা শুরু হয়েছিল ‘অ্যাডোব’-এর। হ্যাঁ, এই সেই সংস্থা— যাকে ছাড়া আজকের ‘ডিজিটাল লাইফ’ প্রায় অসম্পূর্ণ।

গত শুক্রবার চলে গেলেন অ্যাডোবের সহ-প্রতিষ্ঠাতা চার্লস ‘চাক’ গেশকে। যাঁর হাত ধরেই তৈরি হয়েছিল পোর্টেবল ডকুমেন্ট ফরম্যাট প্রযুক্তি। সহজ ভাষায় বলতে গেলে পিডিএফ। ডিজিটাল ডকুমেন্টেশনের ক্ষেত্রে আজও এতটুকু জনপ্রিয়তা হারায়নি ১৯৯৩ সালের সেই প্রযুক্তি। লস আল্টোসের সানফ্রান্সিসকোতে নিজের বাড়িতেই মারা যান চার্লস। বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। অ্যাডোবের পক্ষ থেকে চার্লসের মৃত্যুসংবাদ নিশ্চিত করা হলেও জানানো হয়নি তাঁর মৃত্যুর কারণ।

১৯৩৯ সালে ওহায়োর ক্লিভল্যান্ড শহরে জন্ম চার্লসের। ছোট থেকেই আকর্ষণ ছিল গণিতের প্রতি। এমনকি স্নাতকোত্তর পড়াশোনাও করেন তিনি গণিতেই। তবে তারপরেই হঠাৎ পথ পরিবর্তন। বিষয় বদলে কম্পিউটার বিজ্ঞানে গবেষণা করতে যান কার্নেগ মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে অঙ্ক ছেড়ে দিয়েছিলেন এমনটা ভাবা ভুল। তাঁর গবেষণা ছিল মূলত jঅটিল গাণিতিক অ্যালগরিদম নিয়েই। পরবর্তীতে খ্যাতনামা কম্পিউটার বিজ্ঞানী উইলিয়াম উল্ফের সঙ্গেও কাজ করেছেন তিনি। প্রকাশিত করেছিলেন সফটওয়্যার কম্পাইলারের ওপর একটি গবেষণাপত্র।

১৯৭২ সালে পিএইচডি সম্পূর্ণ করার পর চার্লস পা দেন কর্মক্ষেত্রে। পথ চলা শুরু হয় ‘জেরক্স’ কোম্পানিতে। তাঁর প্রথম প্রোজেক্টই ছিল, বিশ্ববিখ্যাত এই সংস্থাটির জন্য মেনফ্রেম কম্পিউটার তৈরি করা। পরে গ্রাফিক্স, অপটিক্স ও ইমেজ প্রসেসিং-এর ওপরেও একাধিক কাজ করেছেন জেরক্সের হয়ে। সেখানেই তাঁর সঙ্গে আলাপ জন ওয়ার্নকের। 

আরও পড়ুন
সিডি, ক্যাসেট, পোর্টেবল রেকর্ডারের উদ্ভাবক তিনি; প্রয়াত ডাচ প্রযুক্তিবিদ লু অটেন্স

১৯৮২ সালে অফিসের সঙ্গে মতবিরোধে কাজ ছাড়েন চার্লস। হাতে তখন একাধিক বড়ো কোম্পানির সুযোগ। তবে নিজে কিছু করার তাগিয়েই হাঁটা লাগালেন তিনি। সঙ্গ দিলেন জন ওয়ার্নক। চাকরি ছাড়লেন তিনিও। তারপর ওয়ার্নকের গ্যারেজেই গড়ে উঠল ‘অ্যাডোব’। তবে একটা কোম্পানি খুলে ফেলা তো মুখের কথা নয়। তার ওপর, ক্ষেত্র যখন কম্পিউটার প্রসেসিং। বেশ বড়ো অঙ্কের বিনিয়োগ করতে হয়েছিল পকেট থেকেই। ফলে বাড়তি কর্মী রাখার সামর্থ্যও ছিল না দুই কিংবদন্তির। সেসময় কালার সেপারেশন, এনগ্রেভার লুপ ইত্যাদির কাজে সাহায্য করতে হাত লাগাতেন চার্লসের বাবাও। বছর কয়েক এই অসম লড়াইয়ের পর, আর পিছনে ঘুরে তাকাতে হয়নি অ্যাডোবকে। বাকিটা ইতিহাস। কম্পিউটার ও তথ্য-প্রযুক্তিতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির শীর্ষস্থানেই জায়গা করে নিয়েছে অ্যাডোব। তা পিডিএফ রিডারই হোক বা ছবি-ভিডিও এডিটর— সব জায়গাতেই একাধিপত্য তার। 

আরও পড়ুন
কম্পিউটার মাউসের সহ-স্রষ্টা তিনি, নীরবেই চলে গেলেন কিংবদন্তি ইঞ্জিনিয়ার বিল ইংলিশ

বর্তমানে বিশ্বের প্রথম ৪০০টি আন্তর্জাতিক সংস্থার তালিকায় নাম পাওয়া যাবে অ্যাডোবের। এমনকি বিশ্বের সর্বকালীন প্রভাবশালী প্রথম ২০০০টি সংস্থার মধ্যেও জায়গা করে নিয়েছে অ্যাডোব। এই অবিস্মরণীয় কৃতিত্বের জন্য ২০০৯ সালে গেশকে এবং ওয়ার্নককে প্রযুক্তির জাতীয় পদক প্রদান করেন বারাক ওবামা। তাছাড়াও একাধিক সম্মাননা রয়েছে তাঁর ঝুলিতে।

গত বছর বিদায় জানিয়েছিলেন মাউসের স্রষ্টা বিল ইংলিশ। গত মাসে চলে গেলেন ক্যাসেটের জনক অটেন্সও। এবার সেই পথেই পাড়ি দিলেন চার্লস। একে একে যেন নিভিছে দেউটি। ইতি পড়ছে সেই ঐতিহাসিক প্রজন্মে। যাঁরা আজকের মানুষকে স্বাদ দিয়েছিলেন ডিজিটাল-যাপনের…

Powered by Froala Editor