সত্তর বছর আগের কথা। ম্যালেরিয়ায় জেরবার আমেরিকা উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছে মশা তাড়ানোর কোনো অভিনব পদ্ধতির। ‘ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’-এর তরফে বছর চারেকের সাধ্যসাধনার পর একটা উপায় আবিষ্কার করা গেল। দেশের প্রতিটি ঘরে ছড়িয়ে দেওয়া হল ‘ডিডিটি’। যার ফলে মাত্র তিন বছরের মধ্যে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ১৫০০০ থেকে নেমে দাঁড়াল ২০০০-এ। ১৯৫০-এর শেষে তো আমেরিকা থেকে প্রায় মুছে গেল ম্যালেরিয়ার মতো রোগ।
কিন্তু তার আগে? ১৯৩৯ সালে সুইজারল্যান্ডের বিজ্ঞানী পল হেরমান মুলার প্রথম বুঝতে পারেন মশা তাড়াতে ডিডিটি-র কার্যকারিতা। অথচ, বিশ শতকের প্রথম থেকেই ম্যালেরিয়ার উৎপাতে বিধ্বস্ত অবস্থা ছিল আমেরিকা। অনেকেই তখন নিজের মতো চেষ্টা করেছিলেন মশাদের প্রতিহত করার। অধিকাংশই সফল হননি গবেষণায়। আর সেই সময়েই টেক্সাসের পদার্থবিদ চার্লস ক্যাম্পবেল (Charles Campbell) নিয়ে এসেছিলেন বাদুড় দিয়ে মশা মারার আশ্চর্য বুদ্ধি।
যেমন ভাবা, তেমন কাজ। প্রথমে তিনি ঠিক করলেন, বাদুড়দের থাকার জন্য ছোটো ছোটো ঘর তৈরি করবেন। কিন্তু নিজের পকেট থেকে ডলার খরচ করে বাসা বানানোর পরেও কোনো বাদুড় এল না তাঁর আমন্ত্রণে। সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হল পরীক্ষা। তখন মনে হল, বাদুড় আর পাখি একরকম প্রাণী নয়। তাই আরো বড়ো ঘর চাই তাদের জন্য। এবার ৫০০ ডলার খরচ করে পৃথিবীতে প্রথম বাদুড়দের বাড়ি নির্মাণ করলেন ক্যাম্পবেল। ১৯০৭ সালে সান আন্তোনিও-তে প্রতিষ্ঠিত ৩০ ফুট উঁচু টাওয়ারটিকে স্থানীয়রা বলত ‘মনুমেন্ট’। চারটি শক্ত কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে থাকা স্থাপত্যটির মূল ‘বাড়ি’ মাটি থেকে বেশ খানিকটা উপরে অবস্থিত। ধীরে ধীরে ছোটো হয়ে উঠে গেছে উপরের দিকে। গায়ের গর্ত দিয়ে বাদুড়রা এসে ঢুকবে। এমনকি ভিতরে উলটো হয়ে ঝোলার জন্য ব্যবস্থাও রাখলেন ক্যাম্পবেল। ছড়িয়ে দিলেন মাংসখণ্ড।
কিন্তু ফের ব্যর্থ হল সমস্ত পরিশ্রম। কিছুতেই টাওয়ারটিকে নিজেদের ‘বাড়ি’ বলে মনে করত পারল না বাদুড়রা। অন্য জায়গা থেকে ধরে নিয়ে আসা ৫০০ বাদুড়কে কিছুদিন বন্দি করে রেখে দেওয়া হল ভিতরে। যদি তাদের ডাকে আকৃষ্ট হয়ে আশেপাশের সঙ্গীসাথীরা আসে এখানে। সেই ফন্দিও কাজ করল না। রাগের চোটে টাওয়ারটি ভেঙেই ফেললেন ক্যাম্পবেল। কিছুদিন পুরো গুম হয়ে গেলেন তিনি। চাকরি ছেড়ে দিলেন, দূরে চলে গেলেন পরিবারের থেকে। মাথার মধ্যে শুধু ঘুরছে একটাই চিন্তা—বাদুড়দের জন্য বাড়ি এবং তার সাহায্যে মশা তাড়ানো। শুরু করলেন বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো। আর তখনই বুঝতে পারলেন বাদুড়রা সাধারণত বাসা বাঁধে জলাভূমির আশেপাশে। ফলে ক্যাম্পবেলের পরবর্তী টাওয়ারটি তৈরি হল মিচেল লেকের ধারে। এমনিতেও অপরিষ্কার ও অস্বাস্থ্যকর বলে তখন খ্যাতি ছিল লেকটির। একেবারে ম্যালেরিয়ার আঁতুড়ঘর। মশার উপদ্রবে প্রায়ই ফসল ফেলে পালাতে হত চাষিদের। ১৯১১ সালে তিনি যখন টাওয়ারটি প্রতিষ্ঠা করলেন, তখনও শ’খানেক ম্যালেরিয়া আক্রান্ত লোক ছিল মিচেল লেকের আশেপাশে।
আরও পড়ুন
মশা মারতে ছত্রাক দাগা! অভিনব আবিষ্কার বাঙালি গবেষকের
অবশেষে সাফল্যের স্বাদ পেলেন ক্যাম্পবেল। মাস তিনেক পরে ফিরে এসে দেখলেন কয়েকশো বাদুড় বাসা বেঁধেছে তাঁর তৈরি টাওয়ারে। তাতে কিন্তু সন্তুষ্ট হলেন না ক্যাম্পবেল। আরো তো জায়গা রয়েছে ভিতরে। আরো হাজার খানেক বাদুড় সেখানে থাকতে পারে অনায়াসে। যে সংখ্যাটার আদি বাসস্থান ছিল কাছেরই একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে। এক ভোরে, বাদুড়দের বাসায় ফেরার সময় সেই বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলেন ক্যাম্পবেল ও তাঁর এক সঙ্গী। বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র নিয়ে প্রবল শব্দতরঙ্গ তৈরি করলেন দুজনে মিলে। শব্দের বিষয়ে স্পর্শকাতর বাদুড় ভুলেও ওদিকে গেল না আর। সকলে মিলে চলে এল ক্যাম্পবেলের বাড়িতে।
আরও পড়ুন
মশার চাষ, তাও আবার ল্যাবরেটরিতে! অভিনব উদ্যোগ সিঙ্গাপুরে
হিসেবে খুব একটা ভুল করেননি তিনি। ১৯১৪ সালের মধ্যে মিচেল লেক অঞ্চল থেকে ম্যালেরিয়া রোগটিই সম্পূর্ণ উধাও হয়ে গেল। স্বাভাবিকভাবেই শুধু টেক্সাস নয়, সমগ্র আমেরিকাতেই শুরু হল ক্যাম্পবেলের ‘ব্যাট টাওয়ার’-এর চর্চা। টেক্সাসের বিভিন্ন জায়গায় নিষিদ্ধ করা হয় বাদুড় হত্যা। পরের বছর সরকারি খরচে শুরু হয় আরো বেশ কয়েকটি টাওয়ার নির্মাণের কাজ। ১৯২৯ সালের মধ্যে ১৬টি টাওয়ারের কাজ শেষ হয়। সমুদ্র পেরিয়ে সুদূর ইতালিতেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই পদ্ধতি। এদিকে ম্যালেরিয়া কমে যাওয়ার পর মিচেল লেকের টাওয়ারটি হয়ে উঠল বিশেষ দর্শনীয় স্থান। রোজ সন্ধ্যায় হাজার হাজার বাদুড়ের উড়ান দেখতে জমা হতেন অসংখ্য পর্যটক।
পাঁচের দশকে এসে কিন্তু ভেঙে ফেলা হয় টাওয়ারগুলি। ডিডিটি-র জন্য বাদুড়দের প্রয়োজন ফুরিয়েছে বলে নয়, সম্পূর্ণ অন্য কারণে। সেই সময় গুজব ওঠে যে ‘র্যাবিজ’-এর মতো রোগ বাদুড়দের মাধ্যমেই ছড়ায়। ব্যাস, সরকারি খাতায় বিশেষ নিরাপত্তা হারাল তারা। ভেঙে দেওয়া হল অধিকাংশ ঘরবাড়ি। যে বাদুড়দের একসময় খ্যাতি ছিল মশার খাদক হিসেবে, তারাই পরে কলঙ্কিত হয়ে উঠল অন্য রোগের বাহক হওয়ার গুজবে। অবশ্য, তখন গুজব থাকলেও, বাদুড় থেকে যে সংক্রমণ হতে পারে, তা ক্যাম্পবেলের বাড়ি বানানোর একশো বছর পরে ভালো করেই টের পেয়েছে বিশ্ববাসী।
Powered by Froala Editor