একটা বছরের শেষ, আর একটা বছরের শুরু। এমন দিনে উৎসব তো হবেই। কলকাতার কোনো এক জায়গায় একদল সন্ন্যাসী সেবার চড়ক পুজোর আয়োজন করেছিলেন। মহা ধুমধামের মধ্যেই ঘটল অঘটন। চড়কের গাছ থেকে দড়ি বেঁধে পিঠে বাণ ফুঁড়ে ঘুরপাক খাচ্ছিলেন এক যুবক। হঠাৎই সেই দড়ি ছিঁড়ে গেল। আর ঘূর্ণায়মান যুবক সন্ন্যাসী ছিটকে পড়লেন ৬০ হাত দূরে। মাথার খুলি একেবারে গুঁড়িয়ে যায়। শরীরের কোনো অঙ্গই অক্ষত ছিল না। দর্শকদের মধ্যে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তখন আর কারোরই কিছু করার ছিল না। আজ থেকে প্রায় দুই শতক আগে এমনই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার সাক্ষী ছিল শহর কলকাতা। ১৮৩৭ সালের বেঙ্গল হেরাল্ড পত্রিকা থেকে জানা যায় এই দুর্ঘটনার কথা।
দক্ষিণবঙ্গের লোকসংস্কৃতিতে চড়ক পুজো আজও এক বিশেষ জায়গা নিয়ে আছে। আর কলকাতা শহরে তার আয়োজন হবে না, এমন কি হতে পারে? প্রায় ৫৫০ বছর আগে যখন বাংলা নববর্ষের শেষ দিনটিকে উপলক্ষ করে চড়ক পুজোর সূত্রপাত হয়, তখন অবশ্য কলকাতা শহরের পত্তন হয়নি। তবে ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই শহরে চড়ক পুজোর আয়োজনের তথ্য পাওয়া যায়। আজও তো ছাতুবাবু, লাটুবাবুর মেলায় ভিড় কম হয় না।
দুই শতক আগে কিন্তু চড়কের মেলা একেবারেই আজকের মতো ছিল না। এখন সন্ন্যাসীরা চড়কের গাছ থেকে দড়ি ঝুলিয়ে তা বেঁধে নেন পিঠের সঙ্গে। তবে তখন দড়ির সঙ্গে বাঁধা লোহার হুক দিয়ে গেঁথে ফেলা হত সন্ন্যাসীর পিঠ। ভয়ঙ্কর তো বটেই, রীতিমতো বিপজ্জনক ছিল এই পদ্ধতি। নানা সময়ে বিপদের ঘটনা যেমন ঘটেছে, তেমনই আবার অন্যান্য উৎসবের মতো আনন্দ, মশকরাও চলত। দুবছর পর, ১৮৩৯ সালে জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকায় তেমনই এক সংবাদ জানা যায়।
সে-বছর শহর পরিক্রমার সময় চিৎপুর রোডের কাছে এসে সন্ন্যাসীরা পথের ধারেই এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। তবে সে অনুষ্ঠানের মেজাজ যেন একেবারেই ধর্মীয় নয়। গাজন বা চড়কের সন্ন্যাসীদের শিব সাজার রেওয়াজ তো সর্বত্র। এই পুজো তো আসলে শিব ঠাকুরের। তবে ১৮৩৯ সালের এই অনুষ্ঠানে নানা বিচিত্র সাজে সেজেছিলেন সন্ন্যাসীরা। কেউ গণেশ, কেউ কার্তিক। আর সপুত্রক শিব ঠাকুর নানা অঙ্গভঙ্গি করে দর্শকদের মজা দিচ্ছেন। জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকার সংবাদদাতা অবশ্য তাঁদের সন্ন্যাসী না বলে ‘সং’ বলেই উল্লেখ করেছেন। বোঝাই যায়, তথাকথিত নিচু শ্রেণির মানুষের এই উৎসবকে মোটেই সম্মানের চোখে দেখছেন না তিনি।
আরও পড়ুন
চড়ক পূজা ও জেলেপাড়ার সঙ
সংবাদদাতা লিখছেন, “সন্ন্যাসির দল সকল বাণপ্রভৃতি ফুড়িয়া বাদ্যসহিত আসিল এই সকল ব্যাপার সকাল ৯ ঘণ্টাপর্য্যন্ত দেখা যায় পরে তামাসা যাহা দর্শণার্থে অনেক লোক জমা হয়…” অর্থাৎ এই আয়োজনকে কিছুতেই ধর্মীয় উৎসবের স্বীকৃতি দিতে রাজি নন লেখক। তাঁর কাছে এসব নিছক তামাশা। এমনকি অনুষ্ঠানে এক গোদ রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে ঈশ্বর জ্ঞানে পুজো করা হয় বলেও জানানো হয়েছে। কোনো হিন্দু কীভাবে গোদ রোগাক্রান্ত মানুষের পুজো করতে পারে, সেই প্রশ্নও তুলেছেন সংবাদদাতা। এমনকি অনুষ্ঠানকে ঘিরে সন্ন্যাসী এবং দর্শকদের মধ্যে চটুল রসিকতারও উল্লেখ করেছেন তিনি।
তার আগের বছরই কলকাতা শহরে আরও একটি দুর্ঘটনা ঘটে চড়ক পুজোকে কেন্দ্র করে। একসঙ্গে দুজন সন্ন্যাসী ছিটকে পড়েন বেশ কয়েক হাত দূরে। অবশ্য গুরুতর আহত হলেও তাঁরা বেঁচে গিয়েছিলেন। বাণ ফুড়তে গিয়ে শরীরের বহু স্থানে মাংস উঠে এসেছিল। একের পর এক মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী শহর কলকাতার চড়কের আয়োজন। তবে প্রতি বছর মানুষের উৎসাহে ভাঁটা পড়েনি। ১৮৩৯ সালে ভিড় সামলানোর জন্য চড়ক যাত্রার গতিপথ পরিবর্তন করে প্রশাসন। কালীঘাট থেকে মেছুয়াবাজারের পরিবর্তে শোভাযাত্রা যায় সার্কুলার রোড ধরে। ভবানীপুর থেকে চিৎপুর পর্যন্ত। এরও বেশ কয়েক বছর পর, ১৮৬৫ সালে ব্রিটিশ সরকার আইন করে বাণ ফোঁড়া বন্ধ করে। তখন থেকেই দড়ির সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় ঘোরার রেওয়াজ শুরু হয়। দুর্ঘটনা তাতে অনেকটাই কমেছে। অবশ্য গ্রামেগঞ্জে আজও বাণ ফোঁড়ার রীতি চালু আছে। উৎসব তো হবেই, তবে তা যেন মানুষের জীবন কেড়ে না নেয়। আর এবছর মহামারী করোনা পরিস্থিতিতে একটু সতর্ক তো হতেই হবে। বাণ ফোঁড়ার রীতি বন্ধ হোক। আর এবছরের জন্য অনুষ্ঠানের বজায় থাকুক সামাজিক দূরত্বও।
আরও পড়ুন
সংক্রান্তির দিনে, ঋণে জর্জরিত চাষিদের বড়শিতে গেঁথে ঘোরানো হত চড়কের গাছে
তথ্যসূত্রঃ সংবাদপত্রে সেকালের কথা দ্বিতীয় খণ্ড, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সংকলিত
Powered by Froala Editor