১৯৭৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর। গোটা বিশ্ব মেতে উঠেছে বড়োদিনের উৎসবে। গির্জায় গির্জায় চলছে প্রার্থনা; ক্রিসমাস ট্রি, আলো আর উপহারে সেজে উঠেছে সমস্ত জায়গা। কয়েক ঘণ্টা আগেই হয়ে গেছে মিডনাইট মাস। সুইজারল্যান্ডের বাড়িতে, নিজের নরম বিছানায় ঘুমিয়ে আছেন ৮৮ বছরের এক বৃদ্ধ। শরীর দুর্বল, চোখ-মুখের রেখাগুলো আরও গভীরে বসে যাচ্ছে। তিনি নড়াচড়া করছেন না, কিচ্ছু করছেন না; একেবারে স্তব্ধ হয়ে আছেন। কেউ জানতেও পারলেন না, ঘুমের মধ্যেই পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির ওই বৃদ্ধ স্তব্ধ হলেন চিরকালের জন্য। একা, নিঃসঙ্গ হয়ে এবারও ‘বাড়ি’র দিকে পা বাড়ালেন স্যার চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন। এবার আর কেউ তাঁকে বিরক্ত করবে না, কেউ না…
এই মানুষটির সম্পর্কে কোনো বিশেষণই খাটে না। কিংবদন্তি, বিংশ শতকের সবথেকে বড়ো প্রতিভাদের মধ্যে একজন, বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী-বুদ্ধিজীবী… উঁহু! চার্লস চ্যাপলিনের কাছে এসব উপাধি নেহাত সামান্যই। তাঁর পরিচয় তিনি নিজেই— চার্লি চ্যাপলিন। পর্দায় দাঁড়িয়ে যিনি আমাদের হাসাবেন, কাঁদাবেন, শেখাবেন মানুষ হওয়ার মন্ত্র। কিন্তু টু শব্দটি করবেন না। মাছি গোঁফ, লাঠি, ঢোলা প্যান্ট, টাইট কোট— সমাজের চোখে একেবারে বেমানান। কিন্তু চ্যাপলিনের সেই ‘ট্রাম্প’-ই আমাদের সামনে হাজির করায় একটি আয়না। সে যেমন ‘গোল্ড রাশ’-এ আধুনিকতা ও ধনতন্ত্রের অশ্লীলতাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়তে পারে, তেমনই পারে আমাদের কাঁদাতে।
মনে পড়ে, ‘মডার্ন টাইমস’-এর শেষ দৃশ্য? সমস্ত কিছু হারিয়ে পলা গোডার্ডের চরিত্রটি যখন ভেঙে পড়েছে, বারবার জিজ্ঞেস করছে ‘এত চেষ্টা করে কী হল?’। তখন চ্যাপলিন চলে উঠলেন সেই অমোঘ স্বর- ‘কখনও বলবে না, আমি শেষ হয়ে গেছি…’। তারপর একটা দীর্ঘ ফাঁকা রাস্তায় নেমে দুজনে হাঁটতে লাগলেন; কোথায় যাবেন জানা নেই। তবে হাসিটা যেন লেগে থাকে মুখে। এই একটা দৃশ্য চ্যাপলিনকেও চিনতে সাহায্য করে। পর্দায় যে মানুষটা কমেডি, হিউমারের ভগবান; তিনিই ব্যক্তিগত জীবনে এক অসহায়, একা মানুষ। মুখে লেগে আছে হাসি; অথচ শরীর ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত…
মৃত্যুর ঠিক পাঁচ বছর আগের এক সন্ধে। বছর কুড়ি পর আমেরিকার মাটিতে পা দিয়েছিলেন চার্লস চ্যাপলিন। উপলক্ষ্য, অস্কারের অনুষ্ঠান। ১৯৭২-র সেই সন্ধেতেই অস্কারের বিশেষ সম্মান পেয়েছিলেন স্যার চ্যাপলিন। হাত বাড়িয়ে পুরস্কার নেওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ কথা বলতে পারেননি। গোটা হল দাঁড়িয়ে থেকে হাততালি দিয়েছিল সেদিন; প্রায় ১৩ মিনিট! আর চ্যাপলিন? সারাজীবন যিনি হাসিয়ে গেছেন আমাদের, আওয়াজ দিয়েছেন; সেই মানুষটির চোখে তখন জল ঝিলিক মারছে। মনে পড়ছে ইংল্যান্ডের সেই দুর্গম দিনগুলোর কথা? যখন সামান্য বিস্কুট কিনে খাওয়ার মতোও টাকা থাকত না? ‘লিটল ট্রাম্প’-এর মতোই ভবঘুরে, ছন্নছাড়া এক দরিদ্র সন্তান চ্যাপলিন। সেই তখন থেকেই তিনি একা…
চোখের সামনে দেখেছেন নিজের মা-কে ‘পাগল’ হয়ে যেতে। সংসারের চাপ, সমাজের অবমাননা তাঁর স্নায়ুকে এলোমেলো করে দিয়েছিল। চার্লি চ্যাপলিনের সেই সুন্দরী মা, যিনি একসময় মঞ্চে দাপিয়ে বেরিয়েছেন। দশ পেরোনোর বহু আগেই সেই মঞ্চে উঠে এসেছেন চার্লি, নেহাতই পেটের তাগিদে। একদিন ঘরে বসে আছেন চার্লি। মা হ্যানা শুয়ে আছেন; তখনও মানসিক ভারসাম্য হারাননি পুরোপুরি। ছুটতে ছুটতে ঘরে ঢুকল বড়ো ভাই সিডনি চ্যাপলিন। হাতে একটা পার্স। তখন বাসে, ট্রামে কাগজ বিক্রি করত সিডনি। তখনই এই পার্সটি কুড়িয়ে পায় সে। তাড়াতাড়ি খুলে দেখে, ভেতরে প্রচুর পয়সা। এমনকি সোনার মুদ্রাও আছে! হ্যানার চোখ-মুখ চকচক করে উঠল। আচ্ছা, পার্সের মালিক যদি খোঁজাখুঁজি করেন? না, ফিরিয়ে দেওয়াই উচিত। কিন্তু পার্স ঘেঁটে ঠিকানাই পাওয়া গেল না কোনো। ব্যস, মা আর দুই ছেলের আর কোনো বাধা রইল না। বাড়িতে তখন কানাকড়িও নেই, পেটে খাবার নেই। এটা যেন স্বয়ং ভগবানের আশীর্বাদ!
সেই কুড়িয়ে পাওয়া পার্সের দৌলতেই প্রথমবার সমুদ্র দেখলেন ছোট্ট চার্লি। টাকা! অর্থ! কিচ্ছু নেই তাঁর কাছে। পরবর্তীকালে যখন শিখরে দাঁড়িয়ে আছেন চার্লি চ্যাপলিন, তখনও ভুলে যাননি সেই দিনগুলোর কথা। আর পরিশ্রম? একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৯২৮ সাল। মুক্তি পেল ‘দ্য সার্কাস’। সেই বিখ্যাত সিকোয়েন্স, যেখানে সিংহের খাঁচার ভেতর ঢুকে পড়েন চার্লি চ্যাপলিন। খুব বেশি হলে কয়েক মিনিটের দৃশ্য। কিন্তু যখন কাজ করছিলেন, কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না অভিনয়ে। একবার, দুবার… মোট ২০০ বার শট নিয়েছিলেন তিনি। যতক্ষণ না সঠিকভাবে করতে পারছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত থামেননি চ্যাপলিন।
আরও পড়ুন
বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের সঙ্গে চ্যাপলিনের সিনেমা দেখেছেন ভানু, করেছেন গুপ্তচরের কাজও
সিনেমা মানে যে কেবল অভিনয় নয়; নিজের দর্শন, জীবন, রাজনৈতিক আদর্শ, প্রতিবাদ— সমস্ত কিছু তুলে ধরার একটা মাধ্যম সেটা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন চার্লস চ্যাপলিন। শুধুমাত্র তাঁকে আশ্রয় করে আজও কত মানুষ বেঁচে থাকেন। কত মানুষ দুবেলা পেট ভরান ‘চার্লি’ সেজে। চ্যাপলিন যেন আমাদের সবার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছেন। আমাদের মানে, সাধারণ মানুষের। দরিদ্র, ধুঁকতে থাকা মানুষ। ১৯৭৭ সালে তাঁর মৃত্যু যেন একটা অধ্যায় শেষ করে অন্য আরেক অধ্যায় শুরু করল। ঠিক যেভাবে ’৭৮-এ রোমান ওয়ার্ডাস আর গান্টচো গানেভ সুইজারল্যান্ডে চ্যাপলিনের সমাধি খুঁড়ে কফিন তুলে নিয়ে গিয়েছিল। চ্যাপলিনের মৃতদেহ ফেরত পাবেন, কিন্তু তার আগে দিতে হবে মুক্তিপণ। মৃত মানুষের মুক্তিপণ? উঁহু, চ্যাপলিন কি কোনদিনও ‘মৃত’ হবেন? পরবর্তীতে উদ্ধার করে আবারও সুইজারল্যান্ডের সমাধিতে তাঁকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল ঠিকই; কিন্তু এই ঘটনা অন্য এক দরজা খুলে দেয়। চ্যাপলিন কেবল সেলেব্রিটি, বিত্তশালী-বুদ্ধিজীবীদের ঈশ্বর নন। তিনি আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের মসিহা। তিনি প্রতিবাদ, দুঃখ আর একাকিত্বের ককটেল। কিন্তু, মুখে হাসি যে রাখতে হবে!
তথ্যসূত্র –
১) ‘My Autobiography’/ Charles Chaplin
২) ‘জীবনের ট্র্যাজেডি হাসতে শেখায় যাকে, আজ চার্লির জন্মদিন’, এবিপি আনন্দ ওয়েবডেস্ক
৩) ‘চার্লি চ্যাপলিন: বুকে কষ্ট চেপে দর্শকদের মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন যে মহান অভিনেতা’, আল আমিন শুভ, রোর বাংলা
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
স্প্যানিশ ফ্লু প্রাণ কেড়ে নিল প্রথম প্রেমিকার, তিন বছর পরে খবর পেলীন চ্যাপলিন