প্রতিবছর বর্ষা এলেই কারণে প্লাবিত হয় দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। সেইসঙ্গে ঘূর্ণিঝড় তো রয়েইছে। ফলত, একের পর এক বাঁধের ভাঙন লেগেই থাকে দক্ষিণের জেলাগুলিতে। তবে শুধু দক্ষিণবঙ্গই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে গোটা রাজ্যজুড়েই নতুন ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে গঙ্গার ভাঙন। আর নিঃশব্দ এই দানবের অন্যতম শিকার মালদহ। গঙ্গা এবং ফুলহার— মালদহ দিয়ে প্রবাহিত এই দুই প্রধান নদীর দূরত্ব কমছে দ্রুত হারে। গবেষকদের আশঙ্কা, আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই গঙ্গাবক্ষে অস্তিত্ব হারাতে চলেছে ফুলহার। আর তার কারণেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে মালদহের বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
কয়েক দশক আগে পর্যন্তও গঙ্গা এবং ফুলহারের মধ্যবর্তী অঞ্চলের বিস্তৃতি ছিল প্রায় ৩ কিলোমিটারের কাছাকাছি। বর্তমানে এই দুই নদীর মধ্যবর্তী সেই দূরত্ব কমতে কমতে এসে ঠেকেছে মাত্র ১.২ কিলোমিটারে। সমীক্ষা বলছে গঙ্গা-ভাঙন প্রতি বছর গ্রাস করে নিচ্ছে গড়ে ৫০-১০০ মিটার জমি। গঙ্গা ও ফুলহারের মধ্যবর্তী অঞ্চলে রয়েছে দুটি আস্ত গ্রাম পঞ্চায়েত। এই দুই অঞ্চল যে বিপন্ন হবে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। পাশাপাশি থেকে যাচ্ছে আরও বেশ কয়েকটি পঞ্চায়েতের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা।
ভুতাত্ত্বিকদের মতে, আজ থেকে প্রায় ৭৫ কোটি বছর আগে জন্ম হয়েছিল গঙ্গার। গন্ডোয়ানা ল্যান্ডের উত্তরমুখী অভিসারণের সময়। হিমালয় সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই তৈরি হয়েছিল গঙ্গা ও সিন্ধু। দক্ষিণ ভারতীয় পেনিনসুলা অঞ্চলটি বাদ দিলে ভারতীয় ভূখণ্ডের অধিকাংশটাই তৈরি হয় এই দুই নদীর বাহিত পলি দিয়ে। তবে নরম পলিমাটি নির্মিত গাঙ্গেয় অববাহিকা একদিকে যেমন উর্বর, তেমনই ভাঙনশীলও। আর সেই কারণেই বার বার গতিপথ বদলেছে দক্ষিণবাহিনী গঙ্গা। আর তার প্রভাব পড়েছে দুই বাংলায়। বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গে।
গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলে যে জটিল নদীজালিকা লক্ষ্য করা যায় আজ, তার মানচিত্র কয়েক শতক আগেও ছিল ভিন্ন। গঙ্গার দক্ষিণের শাখানদী এবং বৃষ্টির জলপুষ্ঠ উপনদীগুলি ক্রমশ সংযুক্ত পরিবর্তন করেছে তাদের গতিপথ। কখনও নিজেদের মধ্যে সংযুক্ত হয়েছে তারা। কখনও আবার জলস্রোত ও প্রবাহ বৃদ্ধির কারণে জন্ম নিয়েছে আস্ত কোনো নদ। ইতিহাস বলছে, দ্বাদশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত গঙ্গার মূল ধারা প্রবাহিত হত ভাগীরথী নদীর পথেই। আর তা সমুদ্রে মিশত আদিগঙ্গার পথে। পদ্মা ছিল ছোট্ট শাখানদী মাত্র। পরবর্তী চারশো বছরে জলপ্রবাহ বাড়তে বাড়তে ভাগীরথী এবং পদ্মার আয়তন প্রায় সমান হয়ে দাঁড়ায়। তার কারণ, ভাগীরথীতে ক্রমশ পলি পড়ে গতিরুদ্ধ হয় প্রবাহের। গঙ্গার মূল প্রবাহ সরে যায় পদ্মায়। অন্যদিকে ভাগীরথী নদীর মূল জলধারা আদি গঙ্গা থেকে স্থানান্তরিত হয়ে সরে আসে হুগলির পথে।
আরও পড়ুন
গঙ্গার উচ্চপ্রবাহেও মিশছে মাইক্রোপ্লাস্টিক, জানাচ্ছে সাম্প্রতিক গবেষণা
এ তো গেল গঙ্গার মূল গতিপথ পরিবর্তন। ঠিক এইভাবেই ক্রমশ বদলেছে বঙ্গের গাঙ্গেয় উপত্যকাও। ১৬৬০ সালের ফান-ডেন ব্রুকের মানচিত্রে দেখা যায়, গঙ্গার তিনটি ধারায় বিভক্ত হয়েছিল রাজমহল থেকে কাশিমবাজার পর্যন্ত। এক শতকের মধ্যেই পরিবর্তিত হয়ে যায় এই ছবি। ১৭২০ সালে প্রবর্তিত ডেলিসলি-র মানচিত্রে দেখা যায় ক্রমশ পূর্ব দিকে সরেছে ভাগীরথী গঙ্গার মূল গতিপথ। আরও পরে সেসময় গঙ্গার মূল ধারার সমান্তরালে প্রবাহিত হত শিবনারায়ণ নামের একটি নদ। উনিশ শতকের একেবারে শুরুতে, ১৮০১ সালের বন্যার সময় গঙ্গা গ্রাস করে নেয় প্রায় ২৫ হাজার একর জমি। গঙ্গার এই গ্রাসের মুখে অস্তিত্ব মুছে যায় আস্ত শিবনারায়ণ প্রবাহটিরই। একইভাবে গঙ্গাবক্ষে বিলীন হয়ে গেছে কাওর, আত্রেয়ী, অঞ্জনার মতো নদী। এবার সেই তালিকাতেই সাম্প্রতিকতম সংযোজন হতে চলেহে ফুলহার। এমনটাই ধারণা গবেষকদের।
আরও পড়ুন
বারাণসীতে সবুজাভ গঙ্গা, বিষক্রিয়ার আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের
মালদহ জেলায় এই দুই নদী সংলগ্ন অঞ্চলে বসবাস প্রায় লক্ষাধিক মানুষের। গঙ্গা ও ফুলহার মিশে গেলে বাসস্থান হারাবেন তাঁরা সকলেই। বিষয়টির পর্যালোচনা করে ইতিমধ্যেই নড়ে চড়ে বসেছে রাজ্য প্রশাসনের সেচ বিভাগ। মালদহের এই ভাঙন রোধে ১০০ কোটি টাকার বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কথাও চিন্তাভাবনা করছে প্রশাসন। কিন্তু গবেষকদের অনুমান, তাতে খুব একটা লাভ হওয়ার নয়। বাঁধের স্থায়িত্ব নির্ভর করে জলের গতিপ্রকৃতি, নদীর গভীরতা এবং প্রবাহের দিকের ওপর। সেক্ষেত্রে ফুলহার ও গঙ্গার মধ্যবর্তী অঞ্চলের ভৌগলিক প্রকৃতি একেবারেই বাঁধ নির্মাণের অনুকূল নয়। বাঁধ নির্মিত হলে, ভাঙনের গতি খানিকটা কমানো যাবে ঠিকই, কিন্তু তা দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হবে না।
আরও পড়ুন
গঙ্গাতীরে গণকবর, দেশের করোনা-পরিস্থিতির প্রতিফলন উত্তরপ্রদেশে?
ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে সতর্কতা জারি করেছেন রাজ্যের ভূতাত্ত্বিক ও নদী বিশেষজ্ঞরা। পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ল্যান্ড ব্যাঙ্ক তৈরির। বাস্তুচ্যুত লক্ষাধিক মানুষকে যাতে পুনর্বাসন দেওয়া যেতে পারে, তার প্রস্তুতি আগে থেকেই নিতে বলছেন তাঁরা। তবে কত দ্রুত গোটা পরিস্থিতি হাতে বাইরে চলে যাবে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে বলছে পারছেন না কেউ-ই। অন্যদিকে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যেই দিন কাটাচ্ছেন মালদহের স্থানীয় বাসিন্দারা…
Powered by Froala Editor