সময়টা বিংশ শতক। স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ভারত। এরই মধ্যে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর নেতৃত্বে শুরু হয়েছে অসহযোগ আন্দোলন। দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে সেই বিপ্লব। এমন পরিস্থিতির মধ্যে বেড়ে ওঠে বছর পনেরোর এক কিশোর। আগুনের আঁচ টের পায় সেও। জড়িয়ে পড়ে আন্দোলনে। সে তখন বেনারস সেন্ট্রাল কলেজের এক ছাত্র। সেই প্রথম আন্দোলনে নামা, আর সেই প্রথম গ্রেফতার হওয়া। কিন্তু ছেলেটি অকুতোভয়। আদালত চত্বরে দাঁড়িয়ে নিজের আত্মপরিচয় দিল কিশোরটি- “আমি স্বাধীন। আমার নাম আজাদ; চন্দ্রশেখর আজাদ।”
মধ্যপ্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে এক পণ্ডিত পরিবারে বেড়ে ওঠা চন্দ্রশেখরের। বাবার স্বপ্ন, ছেলে সংস্কৃত পণ্ডিত হবে। কিন্তু চন্দ্রশেখরের রক্তে ততদিনে ঢুকে গেছে স্বাধীনতার স্বপ্ন। সেই ১৫ বছর বয়সেই ব্রিটিশদের হাতে অত্যাচারিত হয়েছিলেন তিনি। আর সেটাই জীবনের মোড় বদলে দেয়। গান্ধীজির একান্ত ভক্ত চন্দ্রশেখর যোগ দেন বিপ্লবী দলে। অবশ্য এর সঙ্গে আরও একটি পরিবর্তনও হয়। চন্দ্রশেখর তিওয়ারি থেকে তাঁর উত্তরণ হয় ‘চন্দ্রশেখর আজাদ’-এ…
আরও পড়ুন
প্রেম নিবেদনের কয়েকদিন পরেই ফাঁসি, ১০ বছর ‘ফিরে আসা’র অপেক্ষায় ছিলেন কল্পনা
এ যেন আগুনের মধ্যে দিয়ে নতুন করে জন্ম নিলেন তিনি। বেনারসের রাজেন্দ্রলাল লাহিড়ী এবং শচীন্দ্রনাথ বক্সীর সঙ্গে শুরু হয় বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড। এই সূত্র ধরেই আলাপ রামপ্রসাদ বিসমিলের সঙ্গে। একসঙ্গে মিলে শুরু করেন নতুন বিপ্লবী সংগঠন, ‘হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন’। ১৯২৫ সালের ৮ আগস্ট। সংগঠনের সদস্যরা একসঙ্গে মিলে জরুরি মিটিংয়ে বসলেন। ট্রেন লুট করা হবে। পরের দিনই অনেক সম্পত্তি, কোষাগার নিয়ে একটি ট্রেন যাবে। টার্গেট করা হল সেটাকেই। ঠিক হল, আলমনগর আর কাকোরির মাঝের একটি জায়গায় ট্রেনটি লুট করা হবে। পুরো অভিযানের কমান্ডার-ইন-চিফ করা হল চন্দ্রশেখর আজাদকে। যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। শুরু হয় বিখ্যাত কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলা।
এবারে গ্রেফতারি এড়ালেন চন্দ্রশেখর। আত্মগোপনের সময়ও ছিলেন প্রবল সক্রিয়। ১৯২৮-এর ভগত সিং, রাজগুরুর স্যান্ডার্স হত্যার পেছনেও ছিলেন তিনি। ব্রিটিশ পুলিশের ওয়ান্টেড তালিকাতে উঠে গেলেন চন্দ্রশেখর আজাদ। কিন্তু কোনো খোঁজই যে পাওয়া যাচ্ছে না!
আরও পড়ুন
মৃত্যুর আগের দিন ছুটে গিয়েছিলেন পরিবারের কাছে, বিপ্লবী বাদল গুপ্তকে নিয়ে লিখলেন তাঁর ভাগ্নে
দুর্ঘটনা যখন ঘটে, তখন আকস্মিকভাবেই ঘটে। আর বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনা তো স্বাধীনতার ইতিহাসের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। ১৯৩১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির সকাল। এলাহাবাদের অ্যালফ্রেড পার্কে সুখদেব রাজের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন চন্দ্রশেখর আজাদ। কাছে পিঠেই ছিল আরও একজন। তাঁর পরিচয় জানা যায়নি কোনোদিন। তাঁর মারফৎ খবর চলে যায় ব্রিটিশ পুলিশের কাছে। এই সুযোগ কেউ ছাড়ে! যাকে এতদিন ধরে খুঁজছিল সবাই, আজ একেবারে হাতের মুঠোয়। অ্যালফ্রেড পার্ক ঘিরে ধরে পুলিশ বাহিনী। চন্দ্রশেখরও বুঝে যান, বিপদ আসন্ন। কিন্তু তিতি তো ধরা দেওয়ার পাত্র নন! পকেট থেকে বার করলেন নিজস্ব মাউজার পিস্তলটি। শুরু হল জীবনের শেষ যুদ্ধ। এদিকে গুলিও প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। ঠিক করে ফেললেন চন্দ্রশেখর। পিস্তল তাক করলেন নিজের মাথায়। ট্রিগারের ছোট্ট চাপে মাউজারের শেষ গুলিটি খুলি ফুঁড়ে গেল। নিজের কথাই রাখলেন চন্দ্রশেখর আজাদ। ব্রিটিশের হাতে জীবিত অবস্থায় ধরা পড়লেন না। হয়তো অজ্ঞাতে বেজে উঠছিল তাঁর কথা, “আমার মাউজার শত্রুকে সুযোগ দেবে না আমাকে গ্রেফতার করার”…
Powered by Froala Editor