একটা গোটা প্রজন্ম তাঁর কাজের জাদু থেকে বঞ্চিত। কিন্তু ৮০-৯০-এর দশকের কচিকাঁচাদের কাছে ‘চাঁদমামা’ পত্রিকা আর সেই বিক্রম-বেতালের ছবি এক অন্য নস্টালজিয়ার জগত। আজও বহু মানুষকে সেই ছবি শৈশবের স্মৃতিতে টেনে নিয়ে যায়। আর রেখায়-রঙে সেই সমস্ত ছবিকে মূর্ত করে তুলতেন যিনি, সেই শিল্পী শঙ্কর আর কোনোদিন তুলি ধরবেন না। ৯৬ বছর বয়সে এসে ইতি ঘটল এক রঙিন জীবনের। মঙ্গলবার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন শিল্পী শঙ্কর।
কারাথোলুভু চন্দ্রশেখরন শিবশঙ্করন, ওরফে শিল্পী শঙ্কর। ১৯২৪ সালে তামিলনাড়ুর এক প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে তাঁর জন্ম। কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য চলে আসতে হয় মাদ্রাজ শহরে। সেখানেই ছবি আঁকার শুরু। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সেইসময় নাকি স্কুলের অন্যান্য ছেলেদের জন্যও ছবি এঁকে দিতেন তিনি। তখন স্কুলে ইনস্পেকটর ভিজিটের রেওয়াজ ছিল। তাতে যাতে স্কুলের নাম না ডোবে, তাই এই ব্যবস্থা। কিন্তু ছবি আঁকাকে পেশা হিসাবে বেছে নেবেন, এমন পরিকল্পনা তখন ছিল না।
সেই স্কুলেরই এক শিক্ষক তখন বলেছিলেন, বিএ-এমএ ডিগ্রির পিছনে না ছুটে শিবশঙ্করন যেন ছবি আঁকার কথাই ভাবে। ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়াশোনার পর সেই কথাটাই হঠাৎ মনে পড়েছিল। আর তাই ১৯৪১ সালে ভর্তি হয়ে গেলেন ফাইনআর্টস কলেজে। কিন্তু ছবি আঁকা শেখা তো হল, সংসার চলবে কী করে? কোনোরকমে মাসিক ৫১ টাকা বেতনের কাজ পেলেন ‘কলাইমগল’ পত্রিকায়। পরে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল মাসিক ১৫০ টাকায়। ঠিক এই সময়েই আবার দেখা হয়ে গেল ছেলেবেলার বন্ধু নাগি রেড্ডির সঙ্গে। দুজনে একই স্কুলে পড়তেন। রেড্ডির স্কুলের খাতায় অনেক ছবিও এঁকে দিয়েছেন শঙ্কর। তিনিই ডেকে নিলেন শঙ্করকে। তখন চাঁদমামা সবে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে।
‘চাঁদমামা’-র দপ্তরে শঙ্করের মাইনে হল ৩৫০ টাকা। যদিও খাতায় কলমে সেটা ছিল ৩০০ টাকা। কারণ মূল অলঙ্করনশিল্পী চিত্রার মাইনেই তো ৩৫০ টাকা। তবে দুই শিল্পীর মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতার মধ্যেও একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল অচিরেই। নাগি রেড্ডির কথায়, ‘চাঁদমামা’ একটা গরুর গাড়ি হলে চিত্রা এবং শঙ্কর তার দুই বলদ। কাউকে ছাড়াই চলে না। কিন্তু ১৯৭৯ সালেই মারা গেলেন চিত্রা। তারপর থেকে পুরো দায়িত্বই এসে পড়ল শঙ্করের উপর। অবিরাম এঁকে গিয়েছেন সমস্ত ছবি। আর পত্রিকার প্রচ্ছদ এবং বিক্রম-বেতালের ছবি; এই দুই সৃষ্টি তাঁকে কিংবদন্তি করে তুলল।
৯০-এর দশকের শেষদিকে হঠাৎ আর্থিক কারণে বন্ধ হয়ে গেল ‘চাঁদমামা’। শঙ্করও আর কোথাও কাজ করেননি। ২০১১ সালে আবার পত্রিকার কাজ শুরু হলে ফিরে এলেন শঙ্কর। বয়স তখন ৮৭ বছর। কিন্তু তুলির টান কোথাও কেঁপে যায় না। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত ‘চাঁদমামা’-র জন্য কাজ করে গিয়েছেন। পত্রিকার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়ে উঠেছিল সমার্থক। আজ আর তুলি ধরবেন না শঙ্কর। পত্রিকার ভবিষ্যতও তাই যেন এক অনিশ্চিত অন্ধকারের মধ্যে রয়েছে। পত্রিকার সদস্যরা তো বটেই, শঙ্করের মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ শিল্পী সমাজ।
তথ্যসূত্রঃ বিক্রম, বেতাল অ্যান্ড শঙ্কর, বিশ্বনাথ ঘোষ, দ্য হিন্দু
Powered by Froala Editor