কর্ণাটকের একেবারে সীমানায় ছোট্ট একটা শহর মেত্তুর। সেখান থেকে এগিয়ে গেলেই মুলাকাডু গ্রাম। ভারতের অন্যান্য গ্রামের মতোই সাধারণ চেহারা, অনাড়ম্বর জীবন। সেখানে গেলেই, পাথর আর মাটির মাঝখানে চোখে পড়বে ছোট্ট একটা জায়গা। একটু উঁচু মতন, আর চারিদিকে ইট দিয়ে ঘিরে রাখা। সঙ্গে কিছু পাত্র, ফুলের মালা; গ্রামের লোকেরা এখানে এসে প্রদীপ জ্বালিয়ে যান। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কারোর সমাধি। তবে যে সে মানুষ নন; ভারতের তাবড় পুলিশকে ঘোল খাইয়ে রাখা এক কিংবদন্তি চরিত্র তিনি। আর এভাবেই নির্জনে ঘুমিয়ে আছে সরকারের ত্রাস, চন্দনদস্যু বীরাপ্পন…
পাঠক, নামটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চয়ই চোখের সামনে ভেসে উঠেছে একটি ছবি। খাকি পোশাক, শ্যামলা পেটানো চেহারা, আর আস্ত একটা বন্দুক। আর এই সবকিছু ভেদ করে চলে আসে মস্ত একটা গোঁফ। বীরাপ্পন, ত্রাস আর গোঁফ যেন একসূত্রে মিশে গিয়েছিল। খেয়াল করুন, কোনো খেলোয়াড় বা সিনে জগতের সেলেব্রিটি নয় সে। অথচ বীরাপ্পনের এই গোঁফই স্টাইল স্টেটমেন্ট হয়ে গিয়েছে ভারতে। এমনকি এই গোঁফের কারণেই বীরাপ্পনের প্রেমে পড়েছিলেন তাঁর স্ত্রী মুথুলক্ষ্মী। তৈরি হয় এক রূপকথা; দেশের ডাকাত-গাথার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়।
একেবারে সাধারণ পরিবারের সন্তান সে। কর্ণাটকের প্রত্যন্ত গ্রামের মাটিতেই নেড়ে উঠছিল ছোট্ট বীরাপ্পন। সেই ছেলেই কালে কালে হয়ে উঠল কুখ্যাত ডাকাত। অবশ্য বেড়ে ওঠার সময় চোখের সামনেই ছিল সালভাই গুন্ডারকে। সম্পর্কে বীরাপ্পনের আত্মীয়। সেইসঙ্গে ছিল দক্ষিণের ত্রাস। সেখানের জঙ্গলে তখন সালভাইয়েরই রাজত্ব চলছে। মানুষ মারা তো বটেই; বন্যপ্রাণীও হত্যা করত। আর সে-ই প্রথমবার বন্দুক তুলে দিল ছোট্ট বীরাপ্পনের হাতে। মাত্র ১০ বছর বয়স তার। চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে দাঁতাল হাতি। বড়োদের নজর ওই দাঁতের দিকেই, তবে বন্দুকটি ধরা বীরাপ্পনের হাতে। এক… দুই… তিন… গুলি চালাল বছর দশেকের ছেলেটি। হাতি ধরাশায়ী। শুরু হল একটি জীবন…
ব্যস, লক্ষ্যটা যেন স্থির হয়ে গেল। ১০ বছরে হাতি মারা, ১৭ বছরে প্রথম মানুষ খুন— বীরাপ্পন যেন আতঙ্ক তৈরি করতেই এসেছিল। জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে এমনই কান তৈরি হয়ে গিয়েছিল যে, শুকনো পাতায় পায়ের আওয়াজ শুনেই বীরাপ্পন বুঝে যেত কোন প্রাণী আসছে! ব্যস, একটু একটু করে সাম্রাজ্য তৈরি হতে থাকে দক্ষিণ ভারতে। ‘কুসি মুনিস্বামী বীরাপ্পন’ তখন স্রেফ বীরাপ্পন; আরও ভালো করে বললে চন্দনদস্যু বীরাপ্পন। দক্ষিণ ভারতের গভীর জঙ্গলের একের পর এক চন্দন গাছ হাপিস হতে থাকল। গাছ কেটে সেই কাঠ বিদেশে পাচার করে দিত বীরাপ্পনের দল। শুধু চন্দনকাঠই নয়, এই তালিকায় থাকবে হাতিও। নিজের জীবনকালে অন্তত দুই হাজারের মতো হাতিকে মেরে ফেলেছিল বীরাপ্পন। আর সেই হাতির দাঁত কেটে বিক্রি করত বিদেশে। বদলে চলে আসত লাখ লাখ ডলার…
না, এখনও সেরকমভাবে মানুষ মারেনি। তবে কেউ যদি তার কাজ নিয়ে প্রশ্ন তোলে, বা সমস্ত কিছু বন্ধ করে দেওয়ার রাস্তা নেয়, তাহলে তাঁকে খুন করবে সে। আর এখান থেকেই শুরু হল আরেক অধ্যায়। ১৯৮৭ সাল। তামিলনাড়ুর সত্যমঙ্গলম জেলার ফরেস্ট অফিসার চিদম্বরমকে অপহরণ করা হয়। পরক্ষণেই বীরাপ্পন জানায়, সে-ই এই কাজটি করেছে। কয়েকদিন পর চিদম্বরমের মৃতদেহ পাওয়া যায়। প্রায় একই ঘটনা ঘটে ১৯৯১ সালে। দক্ষিণের এক আইএফএস অফিসার, পান্ডিলাপাল্লি শ্রীনিবাসের লাশ পাওয়া যায় জঙ্গলে। ইনিই একমাত্র অফিসার যিনি বীরাপ্পনকে বাগে পেয়েছিলেন এবং গ্রেফতার করেছিলেন। পরে সেখান থেকেই পালিয়ে যায় চন্দনদস্যু, আর তারপরই এই ঘটনা। এবং এই ঘটনাই তাকে নিয়ে গেল অন্য জায়গায়।
নিজের জীবনে ১৮৪ জনকে খুন করেছিল বীরাপ্পন। এবং মুক্তিপণ আদায় করার জন্য অনেককে অপহরণও করত। সেই তালিকায় যেমন ছিলেন দক্ষিণী সুপারস্টার রাজকুমার, তেমনই ছিলেন মন্ত্রী এইচ নাগাপ্পা। দ্বিতীয়জনকে অবশ্য খুনও করা হয়। শুধু তাই নয়, বীরাপ্পনের পরিকল্পনা ছিল রজনীকান্তকেও অপহরণ করার; সেটা অবশ্য করা যায়নি। একটু সন্দেহ হলেই গুলি চলত বন্দুক থেকে। কাজেই পুলিশের টার্গেটে যে সে থাকবে, তা আর আশ্চর্য কোথায়! ‘অপারেশন কোকুন’-এর নকশা তৈরি হল। খরচ হল কোটি কোটি টাকা। যার মূলে ছিল একজনই মানুষ— বীরাপ্পন। ২০০৪ সালে এনকাউন্টারের আগে বিস্তীর্ণ সময় রীতিমতো ত্রাস সৃষ্টি করেছিল এই মানুষটি। গোটা ভারতের কাছে, পুলিশের খাতায় যে অপরাধী; তাকেই মাথায় করে রেখেছে মুলাকাডু, গোপীনাথাম গ্রামের মানুষেরা। চন্দন কাঠ আর হাতির দাঁত পাচার করে, মুক্তিপণ আদায় করে যা টাকা পেত বীরাপ্পন, সেসব দিয়ে গ্রামের মানুষদের সাহায্য করত। কারোর কোনো অসুবিধা হলেই ছুটে যেত, কাজ করত তাদের জন্য। ভাবুন একবার! একইসঙ্গে রবিনহুড এবং খুনে চরিত্র জন্ম নিয়েছিল এই মানুষটির মধ্যে। এদের হাত ধরেই তো জন্ম হয় মিথের!
আরও পড়ুন
‘এক ঘন্টে সে দেখ রাহা হুঁ, মতলব ক্যা তুমহারা?’ গর্জে উঠলেন চম্বল-কাঁপানো ডাকাত মোহর সিং
তথ্যসূত্র-
১) ‘মৃত্যুর ১৫ বছর পরও বেঁচে বীরাপ্পন, আছেন তামিলনাড়ুর ভোটেও’, সিজার মণ্ডল, আনন্দবাজার পত্রিকা
২) ‘ভারতের এককালের কুখ্যাত ত্রাস ‘চন্দন দস্যু’ বীরাপ্পন’, সামহোয়্যার ইন ব্লগ
Powered by Froala Editor