নদীর কথা বলতে গেলে, 'দেশেবিদেশে'র একটা প্রসঙ্গ খুব মনে পড়ে যায়। গ্রামের পাঠশালার পণ্ডিত হাই তুলতে তুলতে প্রার্থনা করছেন, 'রাধে গো, ব্রজসুন্দরী, পার করো পার করো…'। পরবর্তীকালে নানা দেশ ঘুরে, নানা ভাষা জেনে লেখক কোত্থাও এমন প্রার্থনা শুনতে পাচ্ছেন না আর। তা থেকে বুঝে নিচ্ছেন, নদীমাতৃক বাংলাদেশ ছাড়া পারাপারের এমন দুর্ভাবনা আর কোথায়ই বা থাকবে। নদীমাতৃক বাংলা তথা ভারতবর্ষ। নদীরেখা বেয়েই এখানে প্রাচীন জনপদগুলির জন্ম। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেসব যেমন হারিয়েছে, তেমনি বিলুপ্ত হয়েছে আমাদের প্রচুর নদনদীও।
যেমন ধরা যাক, আদিগঙ্গার কথা। সেই ছোট্টবেলা থেকে শুনে আসছি, কালীঘাটের গা-দিয়ে ওই যে নালার মতো কী একটা বেঁকে গেছে, সেটা আসলে আদিগঙ্গা। কালো কুচকুচে দুর্গন্ধে ম-ম-করা জল। আর তাকেই পরম পবিত্র ভেবে মানুষ পেন্নাম ঠোকে। তার গা ঘেঁষেই কেওড়াতলা মহাশ্মশান। শেষযাত্রা। কিন্তু গঙ্গার আবার আদি কী? কীভাবেই বা সে এমন চলচ্ছক্তিহীন হয়ে গেল?
কলকাতার পুরোনো ছবি যেসব বিদেশি চিত্রকররা এঁকেছেন, সবেতেই কিন্তু গঙ্গার অকুলান স্রোত। কালীঘাটের গায়ে যে আদিগঙ্গা, সে পথেই তো আসত তীর্থযাত্রীরা। গোবিন্দপুর গড়িয়া বারুইপুর শাসন রাজপুর জয়নগরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা এক খরস্রোতা স্ফীত নদী। আজকের সুবিশাল যে বাইপাস রোড- কলকাতার চৌহদ্দি ছাড়িয়ে যা অনেকদূর অবধি সোজা চলে গেছে- আদিগঙ্গার প্রবাহপথ রয়ে গেছে তার গা ধরেই। আদিগঙ্গার পশ্চিম তীরে বেতড়। সেখানে দেবী চণ্ডীর পুজো দিয়ে সপ্তডিঙা ভাসিয়ে আদিগঙ্গা বেয়ে কালীঘাট এসেছিল চাঁদসদাগর। ধনপতির বাণিজ্যযাত্রা আদিগঙ্গা ধরেই। এই নদীর তীরেই চেতলা। চালের আমদানি রপ্তানির জন্যে শয়ে শয়ে নৌকা জমা হত সেখানে। আবার শ্রীচৈতন্যদেব নীলাচল যাত্রাতেও রয়ে গেছে এই নদীর কথা। আদিগঙ্গার তীরে একজায়গায় তাঁর শিষ্যদের নিয়ে অবস্থান করেছিলেন কিছুকাল। সেই জায়গাই আজ পরিচিত বৈষ্ণবঘাটা নামে। চণ্ডীমঙ্গলেও আদিগঙ্গার স্রোতের কথা জানা যায়। ইংরেজ আমলের টালির নালা ও টলিগঞ্জ - দু জায়গাই স্রোতস্বিনী আদিগঙ্গার পরিচয় বহন করে।
এত যে প্রবাহিনী নদী কলকাতাকে ঘিরে ছিল, কীভাবে যেন মুছে গেল সে। গঙ্গা বলতে আমাদের কাছে রয়ে গেল হুগলি নদী। সপ্তদশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত আদিগঙ্গা প্রবাহিত হচ্ছিল বেশ তীব্রভাবেই। কিন্তু হঠাৎই কীভাবে মজে এল এই নদী - এ প্রশ্ন থেকেই যায়।
একদিকে এই আদিগঙ্গা, অন্যদিকে প্রায় একই সময়ে মজে গেল বাংলার অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নদী - সরস্বতী। যার তীরের সপ্তগ্রাম বন্দরের জয়গান শোনা যায় মধ্যযুগ ধরে। এদেশের বণিকদের সাগরপাড়ি দেওয়ার মাধ্যম ছিল আদিগঙ্গা, আর ইউরোপীয় বণিকদের ছিল সরস্বতী নদী। এই আদিগঙ্গার শীর্ণ হয়ে যাওয়ার পিছনে ইউরোপীয় বণিকদের এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়ে গেছে। এখানে অবশ্য ইউরোপীয় বলতে ওলন্দাজদের ভূমিকার কথাই বলা হয়ে থাকে। শোনা যায়, ভাগীরথীর প্রবাহপথে পণ্যবাহী জাহাজ নিয়ে যেতে খুব অসুবিধা হচ্ছিল ওলন্দাজদের।
সরস্বতী ভাগীরথীর মাঝখানে সাঁকরাইল থেকে বেতড় পর্যন্ত খালটি ছিল অত্যন্ত অগভীর। ওলন্দাজ বণিকরা সেই খালটিকেই কেটে আরো চওড়া করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। বাংলার নবাব তখন আলিবর্দি খাঁ। শোনা যায়, এতে তাঁর অনুমতি ছিল। খাল চওড়া হয়ে, তার নাম হল কাটা-গঙ্গা। নৌ-চলাচলের নতুন পথে বাণিজ্য জমে গেল দেদার। কিন্তু এই কৃত্রিম সংযোগে ভাগীরথীর জল আদিগঙ্গায় আর এসে পৌঁছল না। প্রাচীন নদীটি তো এতে মরলই। পাশাপাশি আদিগঙ্গার তীর ধরে গড়ে ওঠা জনপদ, জনবসতিরও বিপুল ক্ষতি হল।
অন্যদিকে হল কী, ওলন্দাজদের হাতে তৈরি কাটা-গঙ্গা - তা দিয়ে গঙ্গারই জল বহমান। কিন্তু জনমানসে কোনোদিন কাটাগঙ্গা গঙ্গার মাহাত্ম্য পায়নি। গঙ্গার আদি প্রবাহ বা আদিগঙ্গার ধারে অনেক হিন্দুতীর্থ গড়ে উঠলেও কাটাগঙ্গাকে কোনোদিন সে মর্যাদা দেয়নি সাধারণ মানুষ। তার পাশে কোনো তীর্থস্থান নেই।
হয়তো সেই আদিগঙ্গার প্রবাহ আজও বজায় থাকলে কলকাতা শহরের ইতিহাস, তার ভৌগোলিক মানচিত্রও কিছুটা অন্যরকম হত। ভালো-মন্দ জানা নেই অবশ্য। তবে কী, মজে-যাওয়া, দুর্গন্ধময়, নর্দমার মতো আদিগঙ্গার তীরে গিয়ে দাঁড়ালে ভারি অদ্ভুত লাগে। এত যে প্রবাহ, এত ইতিহাস যাকে ঘিরে, মানুষেরই নিয়ত হস্তক্ষেপে আজ সে কেমন বোবা। মৃত্যুর পর অস্থি ভাসালে টুপ করে কিছু রেখার সৃষ্টি হয় মাত্র। ঢেউ আর খেলে না।
ঋণঃ বাংলার হারানো নদীর ইতিকথা (আদিগঙ্গ, সরস্বতী, যমুনা বিদ্যাধরী) - প্রীতিতোষ রায়।
Powered by Froala Editor