শ্রীক্ষেত্রে প্রচলিত রাধাতত্ত্বের ব্যাপারে কৌতূহলী শ্রীচৈতন্য, কে দিলেন তাঁর প্রশ্নের উত্তর?

শ্রীচৈতন্য (Chaitanya Deva) মহাপ্রভু যদি না আসতেন, তবে ‘রাধার মহিমা প্রেমরসসীমা’ জগতে কে জানাত? এই প্রশ্ন ভক্ত-কবির। মহাপ্রভুকে রায় রামানন্দ যে রাধাতত্ত্বের কথা শুনিয়েছিলেন, কৃষ্ণদাস কবিরাজের রচনা থেকে এ প্রসঙ্গ অনেকেরই জানা। কিন্তু, তাঁর সমসাময়িক কোনো উৎকল-দেশীয় ভক্তবৈষ্ণবের কাছে মহাপ্রভু রাধাতত্ত্ব শ্রবণ করেছিলেন কি? এ প্রশ্নের উত্তর মিলবে 'শ্রীচৈতন্য চকড়া' গ্রন্থে। 

উৎকল-দেশীয় কবি গোবিন্দ দাস বাবাজী বিরচিত 'শ্রীচৈতন্য চকড়া' গ্রন্থে বলা হয়েছে... একদিন পঞ্চসখার অন্যতম জগন্নাথ দাসের ভাগবত-পাঠ শ্রবণ করে মহাপ্রভু তাঁর প্রিয় পার্ষদ স্বরূপ দামোদরকে বললেন— স্বরূপ, যাও, এঁকে প্রশ্ন করো শ্রীমদ্ভাগবতে কেন শ্রীরাধার নাম অনুল্লিখিত... ‘পচার সে রাধানাম ভাগবতে কাহিঁ নাহিঁ।’ স্বরূপ দামোদরের মুখে এই প্রশ্ন শুনে জগন্নাথ দাস যে উত্তর দিলেন, তার মধ্যেই রয়েছে তৎকালীন শ্রীক্ষেত্রে প্রচলিত রাধাতত্ত্বের সারমর্ম। আমরা বরং কয়েকটি সূত্র আকারে বিষয়টি বর্ণনা করি।

জগন্নাথ দাস বললেন, ‘কৃষ্ণসাধ্য সাধক এ জীব নিরন্তর। সাধনা রাধিতা রাধা প্রেমভাব সার।।’ কৃষ্ণ হলেন 'সাধ্য' বস্তু অর্থাৎ জীবের সাধনার লক্ষ্য, জীব হল তাঁর 'সাধক', আর এই দুয়ের মধ্যে সংযোগকারিণী রাধা হলেন 'সাধনা'। তিনি রাধিতা, অর্থাৎ জীবগণের আরাধ্য তত্ত্ব, এবং তিনিই অনন্ত প্রেমভাবের সার। একইসঙ্গে তিনি 'সাধনা' এবং 'রাধিতা', কারণ ‘রাধা রাসেশ্বরী রম্যা কৃষ্ণমন্ত্রস্য দৈবতম্’... শ্রীরাধা কৃষ্ণমন্ত্র দ্বারা উপাস্য দেবতা, তিনি ও কৃষ্ণ অভিন্ন। 

এই রাধার নিবাস কোথায়? ‘বৃন্দারণ্য অটে অনাহত হৃদচক্র। দিব্যজ্যোতির্ময়ী রাধা নিবাস তত্রৈক।’ জীবের হৃদয়ে যে 'অনাহত' নামক চক্রের কথা তন্ত্রে প্রসিদ্ধ, সেই চক্রেই বৃন্দাবন, সেখানেই শ্রীরাধার নিবাস। ‘মূল প্রকৃত্যে পুরুষে তারতম্য নাই। একের অভাবে অন্যর সত্তা ন রহই।’ শ্রীরাধা মূলপ্রকৃতি এবং কৃষ্ণ পরমপুরুষ, তাঁদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা অসম্ভব, কারণ একের অভাবে অন্যজনের সত্ত্বা থাকে না। শ্রীরাধা নির্বাণদাত্রী, ভুক্তিমুক্তিপ্রদাত্রী, এবং শ্রীকৃষ্ণচরণে নিশ্চলা ভক্তিপ্রদাত্রী।

আরও পড়ুন
ইছাপুর খাল, চৈতন্য-মিথ ও ঘোলা জলের নিঃসঙ্গতা

জগন্নাথ দাস আরও বললেন, শ্রীরাধা গুণাত্মিকা, কৃষ্ণ গুণবাচক বিগ্রহ। গুণবান কৃষ্ণ দৃশ্য, কিন্তু তাঁর গুণাত্মিকা মহাভাবরূপিণী রাধা প্রচ্ছন্ন। কৃষ্ণের প্রাণ রাধা, তাই ভাগবতরূপী কৃষ্ণের শব্দব্রহ্ম-অবতার ভাগবতের প্রাণও রাধা। প্রাণের দ্বারাই শরীর সত্ত্বাবান, সেই শরীর দৃশ্য হলেও প্রাণ সাধারণ-দৃষ্টির অদৃশ্য। তাই শুকমুনির মুখনির্গত কৃষ্ণচরিত্র ভাগবতে স্বয়ং রাসেশ্বরী শ্রীরাধা উহ্য। যেমন গোরাচাঁদের কৃষ্ণতনু রাধাভাবান্বিত, তেমনই ভাগবতে কৃষ্ণ রাধা-বিরহিত৷ অর্থাৎ কৃষ্ণের দ্বিতীয় নরবপু গৌরাঙ্গ ও শব্দব্রহ্ম-শরীর ভাগবত— উভয় শরীরেই শ্রীরাধা প্রচ্ছন্নরূপে বিরাজমান। জয়দেবের গীতগোবিন্দে বলা হয়েছে, ‘হরিমেক রসম্’, সেই রসস্বরূপ কৃষ্ণের আধার অর্থাৎ রসাধার হলেন রাধা। তিনি অপ্রকট, অপ্রকাশ্য। তিনি গোপন না হয়ে প্রকট হলে, ভাগবতের নাম হতো 'রাধালীলামৃত'।

আরও পড়ুন
ফেলে দেওয়া জিনিসের পসরা, চব্বিশ পরগনার ‘ভাঙ্গা মেলা’ ও চৈতন্যের স্মৃতি

জগন্নাথ দাসের মুখে এই রাধাতত্ত্ব দূর থেকে শ্রবণ করে মহাপ্রভু হুঙ্কার দিলেন, ‘হা কৃষ্ণ’ বলে মূর্ছিত হলেন তিনি। জগন্নাথের অত্যন্ত প্রশংসা করে তিনি তাঁর সাথে প্রত্যহ সাক্ষাত ও ভাগবত-চর্চা আরম্ভ করলেন।

আরও পড়ুন
নবদ্বীপ ও কলকাতায় গুরু নানক, দেখা হয়েছিল চৈতন্যের সঙ্গেও!

কথাপ্রসঙ্গে জগন্নাথ দাস আরও বললেন, গোরা রায়, শ্রীক্ষেত্রে রাধার পূজা প্রত্যক্ষভাবে নেই। ‘রাধা হৃদগত ভাব স্তম্ভর প্রমাণ। রাধা অনাহত জ্যোতি প্রীতিভাব জান।’ কৃষ্ণের অপৃথগভূতা আহ্লাদিনী শক্তি শ্রীরাধা অনাহত চক্রে প্রকাশিত জ্যোতিঃস্বরূপিণী, সেই ঘনীভূত কৃষ্ণপ্রীতির জ্যোতির্ময় প্রকাশই সুদর্শন চক্র। এই সুদর্শন চক্র সাক্ষাত রাসমণ্ডল, তাই রাধাষ্টমী দিনে তার আরাধনার বিধি। প্রেমভক্তি-জনিত অষ্টসাত্ত্বিক বিকারের অন্যতম স্তম্ভন, এই কারণেই নীলাচলে সুদর্শনের স্তম্ভসদৃশ আকার। ‘নারায়ণ সহ তার চক্রাত্মক রাসমণ্ডল। জগন্নাথের প্রেম শক্তি স্তম্ভরূপ হেলে।’ জগন্নাথের অন্তর্গত প্রেমশক্তিই স্তম্ভাকৃতি সুদর্শনরূপে নীলাচলে প্রকাশিত, এই চক্র প্রকৃতপক্ষে চক্রাকার রাসমণ্ডল।

'শ্রীচৈতন্য চকড়া' গ্রন্থের সম্পাদক পদ্মশ্রী সদাশিব রথশর্মা এ প্রসঙ্গে পাদটীকায় বলেছেন— সিংহাসনোপরি অধিষ্ঠিত শ্রীজগন্নাথ জীউর বামদিকে স্তম্ভরূপে প্রতিষ্ঠিত সুদর্শন। রাধাষ্টমীর দিন তিনি বেড়াকীর্তন সহ নগর পরিক্রমায় যান। পরিক্রমার পর সমুদ্রতটে শ্মশানের কাছে যমেশ্বর মহাদেব এবং টোটা গোপীনাথ মন্দিরের মধ্যস্থলে তাঁকে স্থাপন করা হয়। জগন্নাথ মন্দিরের বড়ো পাণ্ডা স্বয়ং মাদলাপাঁজী থেকে সমস্ত আয়-ব্যয়ের হিসাব সেখানে পাঠ করেন। শ্রীরাধিকার প্রতিনিধি-স্বরূপ স্তম্ভরূপধারী শ্রীসুদর্শন এই আয়-ব্যয় শ্রবণ করেন। এটিই আজ অবধি চলে আসা রীতি। 

ভারতের সুপ্রাচীন বৈদিক ধর্মসংস্কৃতির সাথে এই রাধাতত্ত্বের সম্পর্ক কী? এ বিষয়ে জগন্নাথ দাস কি কিছু বলেছেন? অবশ্যই! তিনি উদ্ধৃত করেছেন এই উপনিষদ-বাক্য— ‘যতো বাচ নিবর্ত্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহঃ। আনন্দো ব্রহ্মণো বিদ্বান ন বিভেতি কুতশ্চনঃ।' আনন্দস্বরূপ যে ব্রহ্মতত্ত্বের কাছে বাক্য কিংবা মন পৌঁছোতে পারে না, তাঁকে জেনে ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তি সর্বতোভাবে নির্ভয় হন। পরমব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণের এই আনন্দস্বরূপই শ্রীরাধা, শ্রীরাধাকৃষ্ণ-তত্ত্ব সাক্ষাৎকারের অর্থ সকল ভয় থেকে মুক্তি। তাই, জগন্নাথ দাসের ভাষায়, ‘রাধানন্দময়ী সাক্ষাৎ সর্ব্বাপদবিনাশিনী।’ বাক্য-মনের অতীত যে পরমচৈতন্য পরম আনন্দময়, সমস্ত ভয়ের অতীত, সমস্ত বিপত্তির নাশক, তিনিই শ্রীরাধা।

Powered by Froala Editor